অপরাধ: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার সময় ঘাড় চেপে ধরেছিল আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। বালিশচাপা দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে তানভীর ভূঁইয়া ওরফে ভাতিজা তানভীর। ওই সময় খুনিচক্রের আরও অন্তত দুজন আনারের দেহের বিভিন্ন অংশ চেপে ধরে রাখে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মরদেহ একটি চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে টয়লেটে নিয়ে চামড়া ও মাংস আলাদা করা হয়। পুরো হত্যাকাণ্ডে প্রধান কিলার ছিল আমানুল্লাহ। বীভৎসতার নেতৃত্বে ছিল জিহাদ ওরফে কসাই জিহাদ। কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনে এমপি আনারকে হত্যায় খুনিচক্রের কার কী ভূমিকা ছিল, তা তদন্তে এসব তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।
হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত শিমুল, তানভীর ও খুনের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমান ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) রিমান্ডে রয়েছে। এতদিন তানভীরের পুরো পরিচয় জানা না গেলেও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও স্থানীয় সূত্রে কালবেলা নিশ্চিত হয়েছে, এই তানভীর চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহর আপন ভাতিজা। তার বাবা হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া লাকি মূল কিলার আমানুল্লাহর আপন বড় ভাই। তিনি খুলনার ফুলতলা উপজেলায় একটি হাটের ইজারাদার। শুধু তা-ই নয়, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তদন্তকারীরা যাকে অভিযুক্ত করছেন, সেই শাহীন প্রধান কিলার আমানুল্লাহর বেয়াই।
তদন্তকারীদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে তানভীর ভূঁইয়ার বিষয়ে ফুলতলায় স্থানীয় সূত্রের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমানুল্লাহর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য চরমপন্থি হওয়ায় তারা আত্মগোপনে থাকে। প্রকাশ্যেই ছিল তানভীর। সে এক সময় আত্মগোপনে থাকা আমানুল্লাহর নামে চাঁদা সংগ্রহ করত। আমানুল্লাহর স্ত্রী খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তানভীরের। আমানুল্লাহর আপন বোনকে বিয়ে করে ২০০৮ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-লাল পতাকা) প্রধান মিজানুর রহমান টুটুল। এই টুটুল এবং আক্তারুজ্জামান শাহীন আপন চাচাতো ভাই।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমানুল্লাহ তার বেয়াই শাহীনের কাছ থেকে এমপি আনারকে খুনের দায়িত্ব পেয়ে নিজের দলের চরমপন্থি কিলারদের রিক্রুট করে। সে অনুযায়ী জিহাদকে কয়েক মাস আগেই অবৈধ পথে পাঠানো হয় ভারতের মুম্বাই। জিহাদ সেখানে তার মামার মাংসের দোকানে ছিল। পাশাপাশি আমানুল্লাহ তার বিশ্বস্ত ভাতিজা তানভীরকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া চরমপন্থি কিলার মোস্তাফিজ, ফয়সাল ও সিয়ামকেও রিক্রুট করা হয়। এ তিনজন এখনো পলাতক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার ডিবি হেফাজতে থাকা আমানুল্লাহ ও কলকাতা পুলিশের হেফাজতে থাকা কসাই জিহাদ গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে এমপি আনারকে নৃশংস হত্যার বিবরণ দেন। তারা জানান, আনার ১৩ মে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনে যাওয়ার পরপরই তাকে ক্লোরোফরম দিয়ে অচেতন করে ফেলা হয়। তখন তিনি ছটফট করছিলেন। ওই অবস্থায় আমানুল্লাহ তাকে উপড় করে ঘাড়ে চাপ দিয়ে ধরে রাখে। তানভীর তার পা আটকে রেখেছিল। অন্যরা হাত ও দেহের বিভিন্ন অংশ চেপে ধরে। ধীরে ধীরে আনার নিস্তেজ হলে তানভীর তাকে বালিশচাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
কসাই জিহাদ জানিয়েছে, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আনারের নিথর দেহ চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা হয়। এরপর সেটি টয়লেটে নিয়ে ওই অবস্থায় চামড়া আলাদা করা হয়। প্রথমে মুণ্ডু, পরে শরীরের প্রতিটি অংশ থেকে মাংস ও হাড় আলাদা করা হয়। সেগুলোকে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। মাংসগুলো এতটাই ছোট করা হয় যে, একেকটির ওজন ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম হয়ে যায়। এরপর হাড় ও কিছু অংশ প্যাকেট করে লাগেজে ঢোকানো হয়। বাকি অংশ টয়লেটের কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করা হয়। খুনিদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে মঙ্গলবার সঞ্জিভা গার্ডেনের সেপটিক ট্যাঙ্কে তল্লাশি চালিয়ে মাংসের কিছু খণ্ড উদ্ধার করা হয়। এগুলো আনারের দেহের অংশ কি না, তা নিশ্চিত হতে ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠিয়েছে কলকাতা সিআইডি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানুল্লাহর সঙ্গে এমপি আনারের রাজনৈতিক দূরত্ব ছিল। আমানুল্লাহসহ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী খুনের মাস্টারমাইন্ড শাহীন এমপি আনারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার। খুনের আয়োজন করে তিনি নেপাল হয়ে আমেরিকায় পালিয়েছেন। তাকে আইনের আওতায় নেওয়া গেলে অনেক তথ্যই বের হবে।
গতকাল বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান জানান, সংসদ সদস্যকে কী কারণে হত্যা করা হয়েছে অর্থাৎ হত্যার মোটিভ কী, এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশ কিংবা ভারতীয় পুলিশ কেউই উদ্ধার করতে পারেনি। এটার যিনি ষড়যন্ত্রকারী, পরিকল্পনাকারী, সে এখন দেশের বাইরে রয়েছে, তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাই হত্যার কারণ এখনো কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। তাকে (শাহীন) গ্রেপ্তার করলেই শুধু এই হত্যার মোটিভ জানা যাবে।
শাহীন আমেরিকায় রয়েছে, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি নেই, সেক্ষেত্রে করণীয় কী? এমন প্রশ্নে পুলিশ কমিশনার বলেন, এক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে যে ধরনের প্রচেষ্টা করা দরকার, সেটির সর্বোত্তম চেষ্টা করা হবে। যদিও আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সেই ধরনের চুক্তি নেই। তাই অন্য যে কোনো মাধ্যম বা কূটনৈতিক চ্যানেলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
এ ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি কাজে লাগানো হবে কি না, জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, এ ঘটনাটি বাংলাদেশের আইনে বিচার হতে পারে এবং ভারতে যেহেতু ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও বিচার হতে পারে। সুতরাং এটি আমাদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
গত ১২ মে চিকিৎসার কথা বলে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্থলবন্দর দিয়ে কলকাতা যান এমপি আনার। ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি কলকাতায় তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। পরদিন সেই বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। গত ২২ মে ঢাকা ও কলকাতার পুলিশ নিশ্চিত হয়, এমপি আনারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |