পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের একটা কথা বেশ মনে ধরেছে। তিনি বলছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো আদর্শ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’ লাভরভ প্রায় ২০ বছর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। এর আগে ওই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। ফলে তাঁর কথাটা একেবারে ফেলনা নয়।
দেশ ও দেশের বাইরে দলের অনেকে এই শীতে সুখনিদ্রা গেলেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির একটা বড়সংখ্যক নেতা-কর্মী কারাগারে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন, কেউ কেউ হাতেপায়ে ডান্ডাবেড়ি পরে স্বজনের জানাজায় অংশ নিচ্ছেন। এর দায় কে নেবে? এমনটা যে হতে পারে, তা বোঝার জন্য কোনো বড় পণ্ডিত হওয়ার দরকার পড়ে না। আন্দোলন-সংগ্রামে এমনটা হতেই পারে—
নির্বাচন এর ১০ দিনের মাথায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সাথে দেখা করেন। এই সাক্ষাতের পর পিটার হাস কী বলেছেন? বলেছেন, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ব্যবসার সম্প্রসারণ, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ও জলবায়ু পরিবর্তনে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় আমেরিকা। তিনটি শব্দ একটু খেয়াল করুন—নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও ব্যবসা সম্প্রসারণ।
নির্বাচনের পরপরই অবশ্য আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আমেরিকা একমত যে, এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি এবং সব দল এতে অংশ না নেওয়ায় আমরা হতাশ।’ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এমন আকছার মন্তব্য করেই থাকে। কারণ তারা যেটাকে মানদণ্ড মনে করে, সেখানে পৌঁছাতে এসব দেশের এখনো বহুদিন লাগবে, যেমনটা কথকদের লেগেছে।
আমেরিকার নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়—এমন কোনো কাজ বাংলাদেশ করেওনি, করবেও না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দুই বিষয়ে আমেরিকার স্বার্থহানি করা বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য কল্পনার বাইরে। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও তার কোনো অপব্যবহার এ দেশের সরকার করবে না। সময় পাল্টে গেছে, বিশ্বের চিত্র বদলেছে, প্রমাণ হয়েছে বৈরিতা দিয়ে ভালো কিছু অর্জন সম্ভব না।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা ব্যবসা–বাণিজ্যের একটু খোঁজ নেওয়া যাক। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশের নাম আমেরিকা। এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৪১০ কোটি ডলার। আর ১৩৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে চীন আছে পঞ্চম স্থানে। আর এই তালিকায় প্রতিবেশী ভারত আছে দশম স্থানে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ হলো জাপান। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারী বা ঋণদাতা—কোনো হিসাবেই এক নম্বর স্থানে নেই চীন। তাহলে বাংলাদেশ চীনের খপ্পরে চলে যাচ্ছে, সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য আমেরিকার এই অতি সক্রিয়তা—এ কথার যৌক্তিকতা কী খুঁজে পাওয়া যায়?
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের ৬০ শতাংশের ওপর বিনিয়োগ মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর। সেখানে শেভরন, এক্সসেলারেট এনার্জির মতো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এ বছরই সমুদ্রে ২৬টি কূপে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য টেন্ডার আহ্বান করবে বাংলাদেশ। অংশ নিলে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর এই দায়িত্ব পাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। আর এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কাজ করছে—এমন মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে ভিসা, মাস্টারকার্ড, মেটলাইফ, মেটা (ফেসবুক), উবার, এক্সন মোবিল, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, বোয়িং, জেনারেল ইলেকট্রনিক্স। আর নামের দরকার আছে?
শেভরন, এক্সসেলারেট এনার্জির পাশাপাশি ভিসা, মাস্টারকার্ড, মেটলাইফ, মেটা (ফেসবুক), উবার, এক্সন মোবিল, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, বোয়িং, জেনারেল ইলেকট্রনিক্সের মতো মার্কিন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ করছে
এখন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মানুষ অভিবাসী হিসেবে আমেরিকায় বসবাস করছেন। এবং বাস করছেন সুনামের সাথে। এদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই মানুষদের সাথে দেশের আত্মিক, আর্থিক—সব যোগই অটুট। বিরাট সংখ্যায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। আরও অনেকে ভবিষ্যতে যাওয়ার অপেক্ষায়। আমেরিকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিশ্চয় বিশ্বমানের, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই পড়ার সময় তাঁরা বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। আর যারা বৃত্তি পান, তাঁদের কথা বলবেন? বিনা পরিশ্রমে এমন মেধা এত সহজে আর কোত্থেকে ধরা দেবে বলুন। এসব বিচারে কি নিজেদের একটু গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না? শুধুই পোশাক রপ্তানির হিসাবের মধ্যে নিজেদের আটকে রাখবেন? তবে আপনি না ভাবতে পারেন, যারা দুনিয়াটা চালায় তারা এর সবকটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এত বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই।
আর বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে। মানি আর না মানি, ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী বেড়ে চলেছে। এ এক বিরাট বাজার। একে হাতছাড়া করবে কোন বোকা? যাঁরা তাদের কাছে এই বোকামিটা প্রত্যাশা করেছিলেন, তাঁদের বুদ্ধি নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক না!
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
সুত্রঃ ইনডিপেনডেন্ট
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |