রাজনীতি : আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম ও প্রভাবশালী কওমি মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসার অনেক সাবেক শিক্ষার্থী দেশের কওমি অঙ্গনে অতি উজ্জ্বল নাম।
হেফাজতের প্রয়াত আমীর আল্লামা জোনায়েদ বাবুনগরী, মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, বসুন্ধরা ইসলামী রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মুফতি আব্দুর রহমানসহ দেশের অনেক শীর্ষ আলেম শিক্ষার্থী ছিলেন। কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
এজন্য সবসময় প্রশাসনসহ রাজনৈতিক দলের চোখ থাকে প্রতিষ্ঠানটির ওপর। বিশেষ করে ভোট আসলে মাদ্রাসার কদর বেড়ে যায় খুব বেশি। প্রার্থী ও তাদের সহযোগীরা গিয়ে বসে থাকতেন মোহতামিমসহ সিনিয়র আলেমদের কাছে। আর সেখানে গত ১৭ই ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার পর থেকে কোনো প্রার্থী মাদ্রাসাটিতে যাননি। যেখানে প্রতিষ্ঠানটির মোহতামিম (প্রধান পরিচালক) আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় আমীর।
একইসঙ্গে তিনি এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদ্রাসার এক সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ঈগল মার্কার প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহানের ভাই হুজুরের (মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী) সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। শাহজাহান কয়েক বছর আগে হুজুরকে গালি দিয়েছিল। তাই সে এখন ক্ষমা চাইতে ভাইকে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া মাদ্রাসার মাহফিলের সময় (১৪ই ডিসেম্বর) স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু তৈয়ব, সুপ্রিম পার্টির সাইফুদ্দিন ভান্ডারী হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা হুজুরের থেকে দোয়া নিয়ে গেছেন। তবে নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রার্থী মাদ্রাসায় আসেননি। শুধু হেফাজত আমীরের বাবুনগর মাদ্রাসা নয়,
মুন্সীগঞ্জের মধুপুর মাদ্রাসা, নারায়ণগঞ্জের মাদানীগর মাদ্রাসা, ঢাকার বারিধারা মাদ্রাসা, বগুড়ার জামিল মাদ্রাসা, দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসা, জিরি মাদ্রাসা, ময়মনসিংহের বালিয়া মাদ্রাসার মতো শীর্ষ মাদ্রাসাগুলোতে চলতি নির্বাচনে ভোট চাইতে আসেননি কোনো প্রার্থী। এমনকি দেশের কওমি মাদ্রাসার আতুড়ঘর বলে পরিচিত হাটহাজারী মইনুল ইসলাম মাদ্রাসায়ও আসেননি কোনো ভোটযোদ্ধা। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি মাদ্রাসা ছাড়া হেফাজত প্রভাবিত অর্থাৎ অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসায় এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের আনাগোনা একেবারেই কমে গেছে। অনেক জায়গায় সেটি শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেফাজতের এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বলেন, ‘আলেম-উলামাদেরকে তো আল্লাহ নিজেই সম্মান দিয়েছেন। দেশের আপামর তাওহিদি জনতার মাথার তাজ ছিলেন আমাদের আলেম-উলামারা। আর এখন কিছু ব্যক্তি নিজে হালকা-পাতলা সুবিধা নিতে গিয়ে আলেম-উলামাদেরকেই সবার কাছে হালকা করে ফেলেছেন। তারা সামান্য কিছু হালুয়া রুটির জন্য ছোটখাটো নেতাদের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। আর এই সুযোগ নিচ্ছে সরকার ও আলেমবিদ্বেষী শক্তি। তারা মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে সুযোগ বুঝেই উচ্ছিষ্টভোগী বলে উপস্থাপন করছেন। এজন্য হয়তো তারা এখন আমাদেরকে আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন না। তারা ভাবছেন, কয়েকজন আলেমকে কিছু টাকা-পয়সা দিলে তারা সব ম্যানেজ করে নেবেন।’ চট্টগ্রাম শহরের একটি কওমি মাদ্রাসার এ শিক্ষক বলেন, ‘শুনেছি মুফতি ফয়জুল্লাহ (হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব) সরকারকে বুঝিয়েছেন তিনিসহ তার দল ইসলামী ঐক্যজোটের কয়েকজনকে এমপি বানালে তিনি হেফাজত তথা কওমি মাদ্রাসাকে এ নির্বাচন সরকারের পক্ষে কাজ করাতে পারবেন। উনি এটা নিয়ে কাজও করেছেন। কিন্তু গুটিকয়েক আলেম ছাড়া অধিকাংশই তাকে সাড়া দেননি। উনি কয়েকজনকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজেদেরকে এমপি বানানোর প্রস্তাবও দেন।
তবে হক্কানী আলেম-উলামারা ফয়জুল্লাহদেরকে সাড়া দেননি। এজন্য সরকার থেকে তেমন সুবিধা আদায় করতে পারেননি ফয়জুল্লাহ গং। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তিনি নিজেই আর নির্বাচন করছেন না। যদিও হাফেজ্জী হুজুরের সাহেবজাদা আতাউল্লাহ সাহেব (হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমীর) মুন্সীগঞ্জ -১ থেকে নির্বাচন করছেন। তবে উনাকে এখনো কোনো প্রচারণায় দেখা যায়নি। এমনকি তিনি প্রচারণায় গেলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের হাতেই অসম্মানিত হতে পারেন। অথচ তিনি ছিলেন আমাদের মাথার তাজ। শেষ বয়সে তিনি কেন এমন কাজ করলেন, সেটা তিনিই ভালো জানবেন।’ এদিকে ভোটের মাঠে কওমি মাদ্রাসা ও হেফাজত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা মানতে নারাজ মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। হেফাজতের এই যুগ্ম মহাসচিব মানবজমিনকে বলেন, শুধু নির্বাচন নয়, কোনো ক্ষেত্রেই হেফাজত গুরুত্বহীন হয়নি। এমন আজগুবি স্টাইলের ভোটই জনগণের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। আর এটাকে তো কোনো নির্বাচন বলা যাবে না। এটা তাদের নিজেদের কাউন্সিল হচ্ছে।
এটা আমি, ডামি ও আমরার নির্বাচন। এই নির্বাচনে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকবে না। কাজেই তারা হয়তো আমাদের কাছে আসছে না আগের মতো। দীর্ঘদিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আলোচিত এ হেফাজত নেতা বলেন, ‘আমরা নিজেরা ৭ তারিখ ভোটকেন্দ্রে যাবো না। শিক্ষার্থীদেরকেও অনেকটা অলিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এভাবে। এটা জেনে হয়তো প্রার্থীরা আমাদের কাছে আসছেন না। আর সরকার এখন অনেকটা চতুরতার সঙ্গে আমাদেরকে দমানোর চেষ্টা করছে। মামুনুল হক সাহেবেদেরকে মুক্তি দিবে দিবে বলে দিচ্ছে না। আলেম-উলামাদের মামলা প্রত্যাহার করছে না। সর্বশেষ গত ২৯শে তারিখ তারা অনেকটা কূটকৌশল করেই আমাদেরকে ঢাকায় সমাবেশ করতে দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের অন্যতম বৃহত্তম কওমি মাদ্রাসা জামেয়া পটিয়ায় এই মুহূর্তেও সরকারের দুই এমপিসহ তাদের অনুসারীরা অযথা হস্তক্ষেপ ও বাড়াবাড়ি করছেন। এ কারণেও সারা দেশের আলেম-উলামা ও শিক্ষার্থীরা সরকারের ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ। যেকোনো সময় ‘বিস্ফোরণ’ হতে পারে।
এসব জেনে ভয়ে হয়তো তারা আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এই ধরেন, গত ৪ দিন আগে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়ায় নৌকার প্রার্থী ওবায়দুল মোক্তাদির গেলে শিক্ষার্থীরা তার বিরুদ্ধে জুতা মিছিল করেছে। বাধ্য হয়ে তাকে ফেরত যেতে হয়েছে।’ হেফাজতের নায়েবে আমীর ও জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার চাইতে হেফাজতের আমীর ও মহাসচিব ভালো বলতে পারবেন। আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারবো না। তবে আমার বক্তব্য হচ্ছে, এটা ভোটের নামে তামাশা হচ্ছে। আমি, আমার দল জমিয়ত এই তথাকথিত ভোট বর্জন করেছি। আমরা ভোট দিতে যাবো না। এদিকে হেফাজত আমীর গণমাধ্যমে সরাসরি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এ পর্যায়ে বাবুনগরীর বরাত দিয়ে তার এক নাতি বলেন, ‘হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। কাজেই এই নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোযোগ নেই। আর বাবুনগর মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্র হলেও বাবুনগরী ও তার পরিবারের সদস্যরা এবার ভোট দেবেন না। সাধারণ আলেম-উলামারাও ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।’
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |