প্রচ্ছদ রাজনীতি নির্বাচনে যেসব অনিয়ম দেখছেন নৌকার পরাজিত প্রার্থীরা

নির্বাচনে যেসব অনিয়ম দেখছেন নৌকার পরাজিত প্রার্থীরা

রাজনৈতিক : বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক শীর্ষ নেতা ও হেভিওয়েট প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়েও হেরেছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। পরাজয়ের পর তাদের কেউ কেউ অভিযোগ তুলছেন ভোটের ফলাফল কারসাজির। নির্বাচনে অনিয়ম, কালো টাকা ও পেশিশক্তির কাছে হেরেছেন বলেও তাদের কেউ কেউ দাবি করেছেন।

পরাজিত নেতারা অভিযোগ করেছেন, অন্য কোন দল বা প্রার্থী নয়; “নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোকই নৌকাকে আঘাত করেছে”। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য হচ্ছে, এবার অনেকে হেরে গিয়ে যে ধরনের অভিযোগ করছেন, ‘গত সংসদ নির্বাচনে তাদের অনেকেই একই কৌশল করে ভোটে জিতেছিলো’।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই নির্বাচনে অনেক জায়গায় কেন্দ্র থেকে কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ফলে যে প্রার্থীদের পেশিশক্তি ও লোকবল বেশি ছিলো, সেখানে তারা ইচ্ছেমতো নির্বাচনকে ম্যানুপুলেট করেছে। ফলে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীদের অনেকেই হেরেছে’।

তবে দলীয় প্রার্থীদের এই অভিযোগকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা। দলের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘যখন কোন প্রার্থী হেরে যায় তখন তারা নানা মনগড়া কথা বলেন।

পরাজয়ের কারণ নিয়ে যা বলছেন হেভিওয়েটরা

মুন্সীগঞ্জে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে হেরেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ও প্রভাবশালী নেতা মৃণাল কান্তি দাস। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে থেকেই লাগাতার সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। জনগণ আমাকে ভোট দিলেও ফলাফলে তা প্রতিফলিত হয় নি। তাই এই নির্বাচনের ফলাফল আমি প্রত্যাখ্যান করেছি’। এই আসন থেকে বিজয়ী প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাকে ফোনে পাওয়া যায় নি।

প্রায় একই রকমের অভিযোগ আলোচিত সংসদ সদস্য কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমেরও। মানিকগঞ্জ-২ আসনে এবার তিনি হেরেছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর কাছে। মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমি শিল্পী মানুষ। দীর্ঘদিন জামায়াত বিএনপির টার্গেট ছিলাম। আমাকে এখান থেকে সরানোর জন্য অনেক বড় ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে। ভোটের এই ফলকে আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।’

মমতাজকে হারিয়ে এই আসন থেকে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ বলেন, ‘পরাজিত প্রার্থী অনেক ধরনের মন্তব্য করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন দিয়েছে। উনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েও নেত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। উনি বুঝতে পারছেন না উনি নেত্রীকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন’।

বরগুনা-১ আসনকে বলা হয় আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। এই আসন থেকে পাঁচ বার সংসদ সদস্য হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। এই নির্বাচনে তিনি শুধু পরাজিতই হননি, নৌকা মার্কার প্রার্থী হয়েও মি. শম্ভু এবার হয়েছেন তৃতীয়। তিনি বলেন, ‘ভোটার আমাদেরই বেশি। ভোটের ফলাফলে জালিয়াতি হয়েছে। আমরা নির্বাচন কমিশনকে এ নিয়ে অভিযোগও দিয়েছি’।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল নেত্রকোনা-৩ আসন থেকে আগে জিতলেও এবার হেরেছেন নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। তিনি বলছে, ‘আমার টাকা নেই, তাই হেরে গেছি’।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ছিলেন মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য। এবার তিনি হেরেছেন দলের সংরক্ষিত আসনের এমপি তাহমিনা বেগমের কাছে। ভোটের পর গণমাধ্যমের কাছে তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনে নৌকার ভোটারদের ভোট দিতে বাধা ও কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়ার।

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের এমন প্রায় ৩০ জনেরও বেশি এই নির্বাচনে হেরেছেন দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। ভোটের পর তাদের অনেকেই ফলাফল ও ভোটের অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

‘ভোটে হেরে গেলে অনেকে তোতাপাখির মতো অভিযোগ করে, এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ, বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, ‘অনেকে দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য ছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের সাথে জনসম্পৃক্ততা তৈরি করতে পারেনি। ফলে হেভিওয়েট প্রার্থী হয়েও অনেকে হেরে গেছেন। কিন্তু এখন তারা নানা কারণ দাড় করাচ্ছেন’।

‘মানুষ এখন প্রতীকের চেয়ে ব্যক্তি ইমেজকে গুরুত্ব দেয়। ফলে যাদের দলীয় প্রতীক ছিলো না, কিন্তু ক্যারিশমেটিক পাওয়ার ছিলো তারা অনেকেই নৌকার প্রার্থীকে হারিয়েছে’, বিবিসিকে বলেন মিজ খান।

‘কালোটাকা ও পেশিশক্তি’

নৌকা মার্কার প্রার্থী হয়েও ভোটে হেরেছেন আওয়ামী লীগের এমন বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হয় বিবিসির। অনেকেই মোটা দাগে ভোটে হারার কারণ হিসেবে দুষছেন কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবকে।

কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমার এলাকায় বিএনপির ভোট কিনতে কালো টাকা ব্যবহার করেছে প্রতিপক্ষ প্রার্থী। তিনি নির্বাচনে একশো কোটি টাকার বেশি খরচ করেছেন। বিভিন্ন ধরনের উপঢৌকন দিয়েছেন ভোটারদের, সেটা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ দিয়েও কোন লাভ হয় নি’।

মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের ছেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে হেরেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মৃণাল কান্তি দাস। মি. দাস তার পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির প্রভাবকে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল নেত্রকোনা-৩ আসন থেকে আগে জিতলেও এবার হেরেছেন নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। তিনি বলছেন, ‘অঢেল টাকার কাছে অনেকেই বেচাকেনা হয়ে গেছে। আমার টাকা নেই, তাই হেরে গেছি’।

একই রকম অভিযোগ করে বরগুনার ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বিবিসিকে বলেন, ‘এলাকায় এত উন্নয়ন হয়েছে। কালো টাকার প্রভাব যদি না থাকে আওয়ামী লীগ কেন হারবে’?

নির্বাচনে যেসব অনিয়ম দেখেছে নৌকার প্রার্থীরা
সাতই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীদেরই নানা অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্র দখল, ফলাফল জালিয়াতি, অস্তিত্বহীন ভোটারদের ভোট দেওয়া, কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের যেতে বাঁধা দেয়ার মতো অভিযোগ তুলেছেন খোদ আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই।

এ নিয়ে কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। বরগুনার আলোচিত নেতা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, ‘নির্বাচনের দিন তিনটা কেন্দ্রে নৌকাকে ডিস্টার্ব করা হয়েছে। এরপরও ভোটাররা যে ভোট দিয়েছে ঠিক সেই ফল রিটার্নিং অফিসের কন্ট্রোল রুমে আসেনি। ভোটের ফলাফলে জালিয়াতি হয়েছে’।

মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ভোটের দিন ১৬-১৭টি কেন্দ্রে এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে আওয়ামী লীগের এজেন্টদের প্রহার করা হয়েছে’।

তিনি অভিযোগ করেন, ”এজেন্টদের একবার বের করে দেয়া হয়েছে, আবার নতুন সেট পাঠিয়েছি। যে সেট একবার রক্তাক্ত হয়েছে, তাদের আর দ্বিতীয়বার ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি”।

‘দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত দলের সদস্য হিসেবে এরচেয়ে বেশি বলতে পারবো না আমি। তবে অবশ্যই সুযোগ পেলে লিখবো, কি হয়েছিলো আমার নির্বাচনী এলাকায়। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে তা আমি তুলে ধরবো, বলছিলেন মি. দাস।

মি. দাস বলেন, ”এবার দেশের মানুষ আশা করেছে তারা অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। আমার ধারণা অধিকাংশ আসনেই তারা পেরেছে কিছু আসনে পারেনি, তারমধ্যে আমার আসনটি অন্যতম”।

এই অভিযোগ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করে বিজয়ী প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সালের সাথে। তবে তিনি ফোন ধরেন নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদের মনে করেন, অতীতের নির্বাচনে এমন প্রক্রিয়ায় ভোট করে জয় পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা’।

মি. আহমেদ বলেন, ”আগের নির্বাচনে বিএনপিকে ছয়টা সিট দেয়া হয়েছিলো। বিএনপি কী ছয়টা সিটের পার্টি? তাতো না। এবার যারা হেরে গেছে তারা নানা কারচুপির কথা বলছে। গতবার তারা একই পদ্ধতি অবলম্বন করে জিতেছিলো। এবার হেরে যাওয়ায় আহাজারি করছে”।

সংকট নিয়ে যা বলছে আওয়ামী লীগ

এবারের নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এই লড়াই হয়েছে সারাদেশের প্রায় ১৩০টি আসনে। কোথাও নৌকার প্রার্থীর দাপটের কারণে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তবে যে সব আসনে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছে সেখানে সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে।

মানিকগঞ্জের পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম বলেন, ‘এক সময় মানিকগঞ্জ ছিলো বিএনপির ঘাটি। এখানে নৌকার জোয়ার তৈরি করেছিলাম আমি’।

‘এই নির্বাচনের শুরু থেকে মানিকগঞ্জে আওয়ামী লীগকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য বড় ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিলো জাতীয় পর্যায়ের একটা প্রক্রিয়া থেকে। আওয়ামী লীগকে যেভাবে গড়ে তুলছিলাম তা এখন ধ্বংস হয়ে যাবে’, আশঙ্কার কথা জানান মিজ বেগম।

১৯৯১ থেকে ২০১৮। বরগুনা ১ আসন থেকে পাঁচ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। এই নির্বাচনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হারের বিষয়টি তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। মি. শম্ভু বলেন, ‘অন্য দলের বা বাইরের কেউ নয়, এই নির্বাচনে নৌকাকে আঘাত করেছে আওয়ামী লীগের লোকজন। সুযোগ পেলে কারা আওয়ামী লীগের মাথায় আঘাত করবে এই নির্বাচনে তার একটা প্রমাণ পাওয়া গেলো’।

পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস বলছিলেন, এবার দেশের মানুষ আশা করেছে তারা এবার অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। কিন্তু আমার আসনের ভোটারদের অনেকেই সেই সুযোগ পায়নি’।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম জানান, ‘কোন ধরনের উস্কানিমূলক বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা যাবে না বলে দলীয় নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। যারা নির্বাচিত হয়েছে জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছে’।

এই নির্বাচনের পর তৃণমূলের কোন্দলের প্রভাব দলে পড়বে কী না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকারের চাইতে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে দেশের উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে। এই ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। আগামীতেও হবে না’।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদের মত, ‘আগে দলের কেউ বিদ্রোহী হলে তাকে বহিষ্কার করা হতো। এবার তা হচ্ছে না। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যক্তি-গোষ্ঠী পর্যায়ে মারামারি হলেও দলের ওপর প্রভাব পড়বে না’।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।