প্রচ্ছদ হেড লাইন একজন প্রবাদপ্রতীম সেনাপ্রধানের বিদায়

একজন প্রবাদপ্রতীম সেনাপ্রধানের বিদায়

হেড লাইন: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন প্রবাদপ্রতীম সেনাবাহিনী প্রধান (১৯৮৬-১৯৯০) লেফটেন্ট্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, গত ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি সুশৃঙ্খল, সুপ্রশিক্ষিত ও পেশাদার শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে জেনারেলরা অনবদ্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জেনারেল আতিক। জেনারেল আতিকের সৈনিকসুলভ নেতৃত্বগুণ, দৃঢ়তা, সততা, নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, আপসহীনতা, স্বজনপ্রীতিহীন মনোভাব ও সর্বোপরি পেশাদারিত্ব তাকে কালজয়ী একজন সেনানায়কের মর্যাদা দিয়েছে।

জেনারেল আতিকের মৃত্যুর পর তার পরিচিত মানুষের মাঝে বিশেষত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমেছে। তাকে শ্রদ্ধা-স্মরণে ভাসছিল সোশ্যাল মিডিয়ার টাইম লাইন। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জেনারেল আতিক ছিলেন একজন ভালো মানুষ।

প্রিয়জন, সামরিক কর্মকর্তা ও শুভ্যানুধায়ীরা সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আতিককে নানা অভিধায় অভিসিক্ত করেছেন : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক দিকপালের প্রস্থান, কালজয়ী সেনাপ্রধান, পেশাদার সেনাপ্রধান, কিংবদন্তি সেনাপ্রধান, প্রবাদপ্রতীম সেনাপ্রধান, সফল সেনাপ্রধানের গল্প…। ইংরেজিতে কেউ কেউ লিখেছেন- এ গ্রেট চিফ, রোল মডেল, এ চিফ উইন অনার অ্যান্ড ডিগনিটি, লিভিং লিজেন্ড, এ ট্রু সোলজার। ফেসবুকের কল্যাণে এই নিবেদিত প্রাণ-সৈনিকের যাপিতজীবনের কর্মময় প্রায় পূর্ণাঙ্গ অবয়ব প্রস্ফুটিত হয়েছে। এই লেখাটি জে. আতিকের ওপর নির্মোহ কোনো মূল্যায়ণ বা বিশ্লেষণ নয়। স্মৃতিপটে ভেসে আসা জে. আতিকের ওপর আলোচিত কিছু ঘটনা, বিষয়ের চিত্রাংঙ্কনমূলক নিবেদন।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনী প্রধান বিএ- ৫০ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, এনডিসি, পিএসসি ১৯৮৬ সালে ৩০ আগস্ট সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর, ১৯৮৬ সালের ৩১ আগস্ট তারিখে বিএ- ৫৯ লেফটেনেন্ট জেনারেল আতিকুর রহমান জি+ কে চতুর্থ সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। দীর্ঘ চার বছর সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কমান্ড বা পরিচালনা করে এই দিকপাল ফৌজি ১৯৯০ সালের ৩০ আগস্ট তারিখে বিএ- ১১৮ লে. জেনারেল মোহাম্মদ নুরউদ্দীন খান, পিএসসির নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করে অবসরে গমন করেন।

প্রজন্মের বিচিত্র যত অভিজ্ঞতা :

প্রত্যেক প্রজন্মের থাকে স্বকীয়তা, নিজ নিজ অভিজ্ঞতা। জে. আতিকের প্রজন্মের অভিজ্ঞতা বেশ বিচিত্র। তিনি ব্রিটিশ ভারতের পরিমণ্ডলে জন্মে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বড় হয়েছেন। শৈশবে দেখেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘটনাবলি, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশ বিভাগ। পাকিস্তানের শুরুর দিনগুলোতে নতুন আত্মপরিচয়ের উত্তেজনা। কিন্তু মোহমুক্তি হতে বিলম্ব হলো না। দেখলেন নিদারুন বঞ্চনাও বৈষম্য। এরপর দেখলেন ষড়যন্ত্র, আন্দোলন, যুদ্ধ। তারপর এলো মহান ’৭১-এর সংগ্রাম। বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ইতিহাসের এতো পট-পরিবর্তন খুব কম প্রজন্মই দেখেছে। পরে এইসব অভিজ্ঞতা জেনারেল আতিককে সংগ্রামী, রেজিলিয়েন্ট, ধৈর্যশীল, পরিপক্ব ও ভারসাম্যমূলক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।

পাহাড়ে সেনাপ্রধান-সংবাদ :

১৯৮৬ সালের ০১ সেপ্টেম্বর। রাঙ্গামাটির পূর্ব দিকে কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে অবস্থিত রাজমনি পাড়া ক্যাম্পে বিকেলে একটা স্পিড বোট (ট্রাইসার্ক বোট) এসে থামল। বোট থেকে নামলেন ২৫ ইস্ট বেংগলের অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহাম্মদ ফারুক খান (বর্তমানে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী)। অধিনায়ককে সঙ্গে নিয়ে মেজর নেসারউদ্দিন আহমেদ ও আমি পেট্রলসহ পূর্ব দিকে কান্দি ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাই। নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল আতিকের দায়িত্ব গ্রহণের কথা অধিনায়ক আমাদের জানালেন। হ্রদের জলসীমা থেকে আমরা ধীরে ধীরে উঁচু পাহাড়ের পথে চলছি। আমাদের উত্তরে রয়েছে বিশাল উচ্চতার বসন্ত পাহাড়। সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল আতিকের চ্যালেঞ্জগুলো বসন্ত পাহাড়ের মতোই ছিল। তবে তিনি শান্ত, অথচ বলিষ্ঠভাবে, অবিচলিত নেতৃত্বের পথে এগিয়ে যান ও সফল হন।

জন্ম, শৈশব ও শিক্ষাজীবন :

জেনারেল আতিক ১৯৩১ সালের ০১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের (বর্তমান ইন্ডিয়া) মুর্শিদাবাদ জেলার ‘খারেরা’ গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুর রহমান সাবেক ব্রিটিশ-ভারত ও পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। তার মায়ের নাম আফজালা খাতুন। তারা ছিলেন ৬ ভাই, ৪ বোন। নয়াদিল্লির ‘দি ইউনিয়ন একাডেমিতে তিনি একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করাকালীন ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির সময় তার পিতার কর্মস্থল রাওয়ালপিন্ডিতে চলে যান। সেখানে ‘দি গর্ডন কলেজ’-এ (আমেরিকান মিশনারি কলেজ) ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিএসসি পাস করেন। উল্লেখ্য গ্রীষ্মকালের ‘দি ইউনিয়ন একাডেমির কার্যক্রম শীতের ছয় মাস দিল্লিতে এবং গ্রীষ্মের ছয় মাস সিমলাতে পরিচালিত হতো।

মুর্শিদাবাদের খারেরা গ্রাম : জন্মস্থানের স্মৃতি-বিস্তৃতি :

১৯৮১ সালের কথা। মেজর জেনারেল আতিক তখন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি)-এর মহাপরিচালক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায় বিওপি পরিদর্শনে এসেছেন তিনি। স্থানীয় বিডিআর ব্যাটালিয়ান কমান্ডার মেজর শেখ দলিল উদ্দিন আহমেদ তাকে নৌকায় সীমান্তের একটি বিওপির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। সালদা নদী দিয়ে চলছে ছোট্ট নৌকা। ১৯৭১ সালে এটি ছিল ২নং সেক্টরের আলোচিত রণাঙ্গন। কুষ্টিয়ার একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা- মুক্তিযোদ্ধা, মেজর দলিল মহাপরিচালককে ‘খাড়েরা বিওপি’র কথা বলেন- যা তাদের গন্তব্য। ‘খাড়েরা’ বিওপির কথা শুনে জেনারেল আতিক বললেন- ‘দলিল, আমার জন্মস্থান কিন্তু ভারতের মুর্শিদাবাদের ‘খারেরা’ গ্রামে। এরপর কিছুক্ষণ নীরব থাকেন মহাপরিচালক। সম্ভবত তার জন্মস্থানের কথা ভাবছিলেন। যেখানে ১৯৪৭ সালের পরে আর যাওয়া হয়নি। পরেও কোনোদিন আর তার সেখানে যাওয়া হবে না।

সিমলা পাহাড়ের দিনগুলো :

কিশোর বয়সে সিমলার সোনালি দিনের স্মৃতি জে. আতিককে পেছনে ফিরে টানবে। আশ্চর্য ছিল সেই সময়। বিগত ১০০ বছর ধরে বছরে ৫ মাস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গ্রীস্মকালীন রাজধানী হিসেবে সিমলার খ্যাতি প্রতিপত্তি। ৭৩০০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের কোলের মধ্যে নিরিবিলি পরিবেশে এই শৈল শহর অবস্থিত। কী নিবিড় সবুজ, কেমন স্নিগ্ধ শীতল এর পরিবেশ। পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেই দেহমন জুড়িয়ে যাচ্ছে কিশোর আতিকের। চোখের সামনেই ঝকমক করছে তুষারমণ্ডিত সুমহান হিমালয় আর তার গিরি শৃঙ্গগুলো। লম্বা লম্বা দেবদারু গাছগুলো সবুজ পাতার ঘোমটা পরে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতি যেন নিপুণ মালিনীর মতন পাহাড়ের গায়ে সবুজ ফার্ন গাছের কুঞ্জ বানিয়ে রেখেছে।

এপ্রিল মাসে রাজধানী বদলের তোড় জোড়। বড় লাটের সাদা হলুদ রঙের স্পেশাল ট্রেন ভোঁ বাজিয়ে সবাইকে জানান দিয়ে দিল্লি থেকে চলতে শুরু করে সিমলার দিকে…। ফারগাছের গায়ে হেলান দিয়ে এখনও এখানে ফুটে চলেছে লিলি, ডেফোডিল আর রডোডেনড্রন গুচ্ছ। দূরে ঝলমল করছে তুষার মুকুট হিমালয়ের শৃঙ্গ…। সিমলার প্রকৃতি তরুণ আতিকের মনে সৌন্দর্যবোধ জাগিয়ে তোলে। যার প্রভাব থাকবে সারাজীবন। ইউনিয়ন একাডেমির প্রায়- আন্তর্জাতিক পরিবেশ তাকে সকল কাজে কনফিডেন্স জোগাবে পরবর্তীকালে

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান :

গর্ডন কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নবম পিএমএ লং কোর্সের ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৫১ সালের ২৮ আগস্ট কোয়েটার জয়েন্ট সার্ভিসেস প্রি-ক্যাডেট ট্রেনিং স্কুলে যোগদান করেন। লং কোর্সের আড়াই বছরের প্রশিক্ষণের প্রথম ছয় মাস এ প্রতিষ্ঠানে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার নিয়ম প্রচলিত ছিল। অতঃপর বাকি দুবছরের প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৫২ সালের ২৬ মার্চ কাকুলের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে (পিএমএ) যোগদান করেন। দীর্ঘ আড়াই বছর কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৫৪ সালের ১৩ মার্চ আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীর ২০ হেভি এন্টি এয়ারক্রাফ্ট আর্টিলারি রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন।

মার্চের ৩য় সপ্তাহ, ১৯৫৪। সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে নতুন ইউনিটে যোগদানের আগের রাতে রাওয়ালপিন্ডির বাসায় তার পিতা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা আবদুর রহমান চাকরিকালীন দায়িত্ব পালন নিয়ে তার পুত্র সেকেন্ড লে. আতিককে বিভিন্ন উপদেশ দেন। তার পিতা বলেন- ‘সেনাবাহিনীতে তোমার ওপর যেকোনো দায়িত্ব ইবাদত হিসেবেই পালন করবে’। এই উপদেশটি সৈনিক আতিককে সারাজীবন অনুপ্রাণিত করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৫০-এর দশকে রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল আতিকের পিতার ব্রিটিশ আমলের তৈরি বাসস্থানটি ছিল ‘অবান্ধব, স্বজনহীন ও অপরিচিত পরিবেশে’ সুদূর বাংলা থেকে আসা অনেক বাঙালি ক্যাডেট ও তরুণ কর্মকর্তাদের প্রিয় স্থান ছিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যারিয়ার :

তরুণ আতিক যখন সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন (১৯৫১), তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালি অফিসার কর্মরত ছিলেন। বৈষম্যপূর্ণ ও পাঞ্জাবি- প্রভাবিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ব্যাপক প্রতিযোগিতার মধ্যে বাঙালিদের টিকে থাকতে হতো। কারও অনুকম্পা অনুগ্রহ নয় নিজেদের যোগ্যতার বলে প্রবল প্রতিযোগিতারে ভিতর দিয়ে বাঙালি সেনাকর্মকর্তারা তাদের আসন তৈরি করে নিয়েছিলেন। আর্টিলারি কোরে এ প্রতিযোগিতা ছিল আরও বেশি। শুরু থেকেই তিনি একটি চমৎকার ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। প্রশিক্ষণ কোর্সেগুলোতে (মোট ১৩টি) মেধার পরিচয় দেন।

ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান ব্রিগেডিয়ার খাজা ওয়াসিউদ্দিন (পরে লে. জেনারেল, রাষ্ট্রদূত) ১৯৫৯-৬০ সালে আর্টিলারি পরিদপ্তরের পরিচালক ছিলেন। তার স্টাফ অফিসার ছিলেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান (পরে লে. কর্নেল, বীর উত্তম, ৭ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার)। তরুণ আতিক এই দুজন জ্যেষ্ঠ আর্টিলারি অফিসারদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

জে. আতিক মালির সেনানিবাসস্থ বিমান বিধ্বংসী গোলন্দাজ স্কুল থেকে গানারি স্টাফ কোর্স ও যুক্তরাষ্ট্রের গাইডেড মিসাইল স্কুল থেকে ‘ইলেকট্রনিক্স’-এর ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি গোলন্দাজ বাহিনীর সব স্তরে চাকরি করার দুর্লভ সুযোগের অধিকারী। নিজেকে একজন ভালো ‘রেজিমেন্টাল সোলজার’ হিসেবে গড়ে তোলেন। পরে কমান্ড, স্টাফ এবং প্রেষণে বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। তিনি মেজর হিসেবে ইন্টার সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের (আইএসএসবি) গ্রাউন্ড টেস্টিং অফিসার (জিটিও) হিসেবে কাজ করেন। লে. কর্নেল আতিক ১৩ এলএএ রেজিমেন্ট আর্টিলারির অধিনায়ক, (কমান্ডিং অফিসার) ছিলেন। সুদক্ষ আর্টিলারি অফিসার হিসেবে আর্টিলারি ইউনিটের পরিবেশগত প্রোথিত, মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের বিষয়টি পরবর্তী উচ্চতর নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনকালে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

আরব সাগর তীরে একাকী বাঙালি ক্যাপ্টেন :

১৯৫০- দশকের শেষের দিকের একটি ঘটনা। করাচির কাছে আরব সাগর তীরের এক রেঞ্জে বিমান বিধ্বংসী আর্টিলারি রেজিমেন্টের কোর্স শুটিং চলছে। বিমান বিধ্বংসী গান বা কামান দিয়ে সমুদ্রের উপরে উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তুতে (বেলুন) ফায়ার করা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাটারির ফায়ারিংয়ের পর তরুণ অফিসাররা ফায়ার করছেন। কিছুটা পরীক্ষার মতো। এবার ফায়ার করবেন রেজিমেন্টের একমাত্র বাঙালি অফিসার ক্যাপটেন আতিক। তখন সব কিছু ম্যানুয়েল। লিড ক্যালকুলেশন করলেন তিনি গানের গেজেটে। এলিভেশন ট্রাকিং শুরু হলো। লক করা হলো টার্গেট। সবার লক্ষ্য এই বাঙালি অফিসার কী করছে? টেনসন হচ্ছে তবুও ধীর স্থিরভাবে কাজ করছেন এই ক্যাপটেন। একমাত্র বাঙালি অফিসার কি পারবে আজ বাঙালির মান বাচাঁতে? এবার ফায়ার করলেন আতিক। লক্ষ্য বস্তু– বেলুন ধ্বংস হলো। সেদিন এভাবেই যেন বাংলা মায়ের সম্মান রেখেছিলেন তরুণ বাঙালি ক্যাপটেন। তবে বেলুনের মতো চুপসে গেল রেজিমেন্টের কয়েকজন অবাঙালি কর্মকর্তা। ক্যাপটেন আতিক ফায়ারিং এ ব্যর্থ হলে যারা বেশ উল্লসিত হতেন।

সৌভাগ্যক্রমে জে. আতিকের সঙ্গে অনেকবার তার জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার আমার সুযোগ হয়েছে। একবার রাওয়ার অনুষ্ঠানে দেখা হলে আলাপচারিতায় জে. আতিক আমাদের কয়েকজনকে বলেছিলেন- ‘তোমরা কতো ভাগ্যবান। আর্মিতে এখন প্রায় সবাই বাঙালি। আমাদের সময় প্রতি পদে সতর্ক হয়ে চলতে হতো। তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল। তবে আমরা যোগ্যতা দিয়েই নিজেদের আসন অধিকার করতাম’।

বিবাহ ও পরিবারের সাতকাহন :

তৎকালীন তরুণ অফিসার ক্যাপটেন আতিক ১৯৬১ সালে বেগম মুনিরা মহব্বতের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহত্তোর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকার শাহবাগ হোটেলে। সেই অনুষ্ঠানে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এলাকা থেকে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন। বেগম মুনিরা আতিকের শিকড় প্রথিত রয়েছে দেলদুয়ারের জমিদার বাড়িতে।

বেগম মুনিরা আতিক অত্যন্ত সামাজিক, দয়ালু ও সুগৃহিণী মহিলা ছিলেন। সেনাপরিবার কল্যাণ সমিতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানকে তিনি সুসংগঠিত করেন। এই দম্পত্তির তিন সন্তান। ছেলে : শফিকুর রহমান ও আকিলুর রহমান। মেয়ে : ডা. মাহেরা আতিক। সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বেগম আতিক ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

ক্যাপটেন আতিকের বিয়ের সময় বেশ মজার একটা ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে রাওয়া থেকে প্রকাশিত ‘রাওয়া মিরর’ পত্রিকায় মেজর আবদুল গণি: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠনে তার অবদান শীর্ষক তার একটি ছোট্ট প্রবন্ধ ছাপা হয়। সেই লেখায় প্রচারবিমুখ এই জেনারেল, তার ব্যক্তিগত একটি মজার বিষয় শেয়ার করেন। ওই সময় (১৯৫০-৬০ দশক) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রভাবান্বিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার মেসে ও বাজারে সুরা অবাধে পাওয়া যেত। সুরাপানের ব্যাপারটা গভীরভাবে বাঙালি অভিভাবকদের মনে প্রোথিত হয়েছিল। ক্যাপটেন আতিকের হবু শাশুড়ি সেই সময়ে তার দূর সম্পর্কের ভাই ক্যাপটেন কাজী গোলাম দস্তগীরকে (পরে মেজর জেনারেল) জিজ্ঞাসা করেন ক্যাপটেন আতিক সুরা পান করেন কিনা? উত্তরে ক্যাপটেন দস্তগীর বলেন- ‘বুবু, আমি পান-সিগারেট-চা খাই ও (ক্যাপ্টেন আতিক) তাও খায় না। সুরা তো দূরের কথা।

মান্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্পে দুর্বিষহ যে জীবন :

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উঠলো। পূর্বদিকে স্বাধীন বাংলাদেশে তখন বিজয়ের আনন্দ-হিন্দোল। কিন্তু পশ্চিম দিকে, পাকিস্তানে খাঁচাবন্দি হয়ে গেল প্রায় ২৮ হাজার বাঙালি সৈনিকসহ প্রায় ২ লক্ষ বাঙালি। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর সহায়তায় বাংলাদেশ বেতারযোগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ধারা বিবরণী শুনছিলেন লে. কর্নেল আতিক। অদ্ভুত আবেগ আর আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মন ভরে গেল এই কর্নেলের।

কিন্তু আবার অনিশ্চিত জীবন শুরু হলো। পাঞ্জাবের মান্ডি বাহাউদ্দিন ক্যাম্পে ছিল বন্দি ছিলেন লে. কর্নেল আতিকসহ কয়েকশ অফিসার ও সৈনিক। চতুর্দিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করা ছিল এই ক্যাম্প। কাঁটা তারগুলো ছিল বিদ্যুতায়িত। এই পরিস্থিতিতেও অসহনীয় অবস্থা থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পের বেশ কিছু তরুণ সেনা কর্মকর্তা পালানোর চেষ্টা করলেন। টানেল কেটে কেউ কেউ পালাতে সক্ষমও হলেন নাটকীয়ভাবে। প্রত্যেকের পালানোর ইতিহাস অশ্রুতভাবে রোমাঞ্চকর। অনেক বছর পর লে. কর্নেল এম এ হামিদ তার ‘একাত্তরের যুদ্ধে জয় পরাজয়, মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের দৃশ্যপট’ গ্রন্থে লিখবেন ক্যাম্পের দুর্বিসহ জীবন ও শ্বাসরুদ্ধকর পালানোর ঘটনা।

ক্যাম্পের অসহনীয় জীবন। দেশে ফেরার সকল পথ বন্ধ। এর মধ্যেও পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের বাংলাদেশে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু- সরকারের উদ্যোগগুলো মনে আশা জাগাতো। বিবিসির বাংলা বিভাগের মাধ্যমে দেশের আত্মীয়স্বজনের বার্তা শোনার ব্যবস্থা ছিল। এটিই সৈনিকদের মন চাঙ্গা করে রাখতো। এতো হতাশা অবসাদ অনিশ্চয়তার মধ্যেও কর্নেল আতিক মনে করতেন যে একদিন আলো আসবেই।

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলো। সংসারের অধিকাংশ জিনিস ফেলে আসতে হলেও লে. কর্নেল আতিক গোপনে তার কাছে থাকা আর্টিলারির কিছু প্রেসি, প্যামপ্লেট সুটকেসে নিয়ে এলেন কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই। ক্যাম্পের ‘দুর্ধর্ষ’ পাকিস্তানি কমান্ডার জানতেই পারলো না যে ক্যাম্প থেকে ‘পাচার’ হয়ে যাওয়া পাকিস্তান আর্মির আর্টিলারি প্যামপ্লেট নিয়েই একদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ট্রেনিং যথাযথভাবে শুরু হবে।

প্রত্যাবাসন পর্ব- ১৯৭৩ :

প্রায় পৌনে ২ বছর পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যাম্পে অন্তরীন প্রায় ২ লক্ষ বাঙালির চরম দুঃখের দিন শেষ হলো। বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন বা রিপ্যার্টিয়েশন শুরু হলো প্রথম ব্যাচের সামরিক-অসামরিক ১৬৮ জন বাঙালি নিয়ে। তাদের নিয়ে ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬:৪০ মিনিটে আরিয়ানা আফগান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে ল্যান্ড করলো। সন্ধ্যায় বিমান বন্দরে হাজার হাজার মানুষ (মূলত আত্মীয়স্বজন) তাদের প্রীতি ও ভালোবাসা ঢেলে মাতৃভূমিতে স্বাগত জানায়। আত্মীয়স্বজন জানতো না এই ফ্লাইটে কে কে আসবেন। উড়োজাহাজটি ঢাকার মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয় মর্মস্পর্শী দৃশ্যের। সমবেত জনতা মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে ওঠেন। সব নিয়মকানুন ভেঙে টার্মিনাল ভবনে হাজারো জনতা খুঁজে বেড়ায় প্রিয়জনকে।

অবশেষে পরিবারগুলো নেমে আসতে থাকে উড়ো জাহাজ থেকে। এই সময় বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর সিজিএস মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম। প্রথমে শিশু পুত্র কন্যার হাত ধরে সস্ত্রীক নেমে এলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাহসী কর্মকর্তা মেজর আবু ওয়াহিদ মোহাম্মদ নুরুল আজিম (পরে লে. কর্নেল, শহীদ)। সবার চোখে মুখে কী আনন্দ। বাংলার মাটি স্পর্শ করার পর স্বাধীন আকাশের দিকে হাত ছুড়ে মেজর আজিম বললেন ‘জয় বাংলা’। পরের দিন দৈনিক বাংলার হেড লাইন ছিল- ‘স্বদেশের মুক্ত মাটিতে ওরা ফিরলেন’।

এর প্রায় ১০ দিন পর, ১৯৭৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আরিয়ানা আফগান এয়ার লাইন্সের একটি প্লেনে লাহোর থেকে সপরিবারে রওনা করলেন লেঃ কর্নেল আতিক। তার কাছে দু-আড়াই ঘণ্টা সময়কে মনে হচ্ছে যেন দু’ হাজার ঘন্টা। প্লেন কখন প্রিয় বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করবে? আর কখন মাটি ছুঁয়ে দেখব? ভাবছেন কর্নেল আতিক। অবশেষে ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকায় এসে পৌঁছালেন তারা।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন যে জীবন :

বাংলাদেশে লে. কর্নেল আতিকের নতুন জীবন শুরু হলো। প্রথম কিছুদিন ঢাকাস্থ স্টেশন হেডকোয়াটার্সে কাটলো। এরপর ১৯৭৩ সালের ১৩ নভেম্বর পোস্টিং হলো সেনাবাহিনী সদরদপ্তরের আর্টিলারি পরিদপ্তরের স্থানাপন্ন পরিচালক হিসেবে।

ঢাকা সেনানিবাসস্থ পাকিস্তান আমলের ১৪ ডিভিশন সদর দপ্তরেই গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদরদপ্তর। এখানে তখন নতুন পরিবেশ, পরিস্থিতি। সেনাবাহিনী প্রধান, উপসেনাপ্রধান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে বিএ- ৫১২১ মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম, বিএ- ৬৯ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, (পরে লে. জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) ও বিএ- ৫৫৫৩ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম। এরা সবাই মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বীর সেনানায়ক। তবে চাকরিতে সবাই লে. কর্নেল আতিকের জুনিয়র। একজন পেশাদার সৈনিক হিসেবে বাস্তবতা মেনে তিনি সেনাবাহিনী তথা দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করলেন।

আর্টিলারি পরিদপ্তরের প্রথম পরিচালক :

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুজিব ব্যাটারি’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আর্টিলারি সংযুক্ত হয়। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে লে. কর্নেল আতিক ১৯৭৩ সালের ১৩ নভেম্বর সেনাসদরে আর্টিলারি বা গোলন্দাজ পরিদপ্তরের প্রথম পরিচালক হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। তার পূর্বে আর্টিলারি পরিদপ্তর এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন তৎকালীন মেজর আবু তাহের সালাউদ্দিন, বীর প্রতীক (পরে কর্নেল)। ১৫ মে ১৯৭৪ সালে তিনি কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। নবগঠিত আর্টিলারি কোরের উন্নতির জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।

তিনি তার পেশাগত দক্ষতা দিয়ে অত্যন্ত সীমিত সুযোগ-সুবিধা, স্বল্প বাজেট ও নানাবিধ জটিলতার মধ্যেও নতুন গড়ে ওঠা গোলন্দাজ বাহিনীকে পেশাগতভাবে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রশিক্ষণ পুস্তিকা, প্রেসি-প্যামপ্লেট ছাপানো, ফিল্ড ফায়ারিং, প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে অস্ত্র-গোলাবারূদের সংস্থানসহ একে ঢেলে সাজানোর বিভিন্ন প্রকার কর্মকাণ্ড কর্নেল আতিক পরিচালনা করেছিলেন। সেই সময় সেনাসদর নেতৃত্বও তাকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। একদিন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম সেনাসদরে সকল পরিচালককে তার অফিসে ডাকলেন। এই সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অন্য পরিচালকদের সামনে আর্টিলারি পরিদপ্তরের পরিচালক (কর্নেল আতিক) এর বিভিন্ন উদ্যোগের কথা (বিশেষত নিজ উদ্যোগে আর্টিলারি প্যামপ্লেট ছাপানো) অন্য পরিচালকদের জানান এবং তাকে অনুসরণ করে এরকম উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন। জেনারেল আতিককে গোলন্দাজ বাহিনীর ভিত্তিস্থাপক বলা যেতে পারে। পরে তিনি ছিলেন গোলন্দাজ বাহিনীর প্রথম ‘কর্নেল কম্যান্ডেন্ট’।

চট্টগ্রামে নতুন পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা :

১৯৭৫ সালের ২৩ অক্টোবর তার বদলি হয় চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ৬৫ পদাতিক ব্রিগেডের ‘কমান্ডার’ হিসেবে। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই তারিখে তৎকালীন ৬৫ পদাতিক ব্রিগেডের অধীনস্থ কয়েকটি ইউনিট নিয়ে ব্রিগেডিয়ার আতিকের নেতৃত্বে ২৪ পদাতিক লাইট পদাতিক ডিভিশন নামে ২৪ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি ১৯ এপ্রিল ১৯৭৬ সালে কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

উল্লেখ্য, ব্রিগেডিয়ার আতিক যখন চট্টগ্রামে ৬৫ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার, সেই সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য ১৯৭৬ সালের ১৮ জুলাই তারিখে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানার তক্তানালার কাছে মালুমিয়া (পাংকুপাড়া) পাহাড়ে পুলিশ টহলের ওপর শান্তিবাহিনীর একটি দল আক্রমণ করে। এর বহু বছর পর বিলাইছড়ি এলাকায় চাকরিকালে বিশদভাবে জানবো সে ঘটনা। ১৯৭৬ সালের ১৮ জুলাইকে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের শুরু ধরা হয়। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (১৯৭২) সশস্ত্র শাখা ‘শান্তি বাহিনী’ গঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালের ৬ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশনে’ মোতায়েন করে। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু- সরকারের সময়কালে ১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩টি সেনাবাহিনী গ্যারিসন গড়ে ওঠে। বলা যায়, প্রথম জিওসি হিসেবে পাহাড়ে ইমারজেন্সির প্রাথমিক ধাক্কা তিনিই সামলে ছিলেন।

এরপর ব্রিগেডিয়ার আতিকের বদলি হয় সেনাসদরে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) হিসেবে। এ পদে তিনি স্বল্প সময়ে দায়িত্বরত থেকেও দক্ষতার সঙ্গে সকল পদবীর বাসস্থান সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ২৫ আগস্ট ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নিত হন।

মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রাইফেলস্ (বিডিআর) :

কিউএমজি পদ হতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের ১৫ ডিসেম্বরে তাকে বাংলাদেশ রাইফেলস্ বা বিডিআর-এর (বর্তমানে বিজিবি) মহাপরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। তিনি ব্যাপকভাবে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও উন্নয়ন সাধনে কাজ করেন। তিনি চোরাকারবার দমন করতে খুবই সফলতার পরিচয় দেন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নিজের দেশের স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম হন। তিনি বিডিআর সদস্যদের মনোবল উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন।

১৯৮৩ সালের ২৫ মে বিডিআর হতে তার বদলি হয় ‘সি ইন সি’স সেক্রেটারিয়েট-এ (বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ) প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে। এর পর সিএমএলএ’স সেক্রেটারিয়েটে পিএসও ও সেনাসদরে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল (১৯৮৬) হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন :

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চতুর্থ সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি চ্যালেঞ্জিং একটি সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল এই যে, তিনি ছিলেন দেশের রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক জেনারেল এরশাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। উচ্চাভিলাষহীন ও পেশাদার জেনারেল আতিক তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, পেশাগত দক্ষতা ও দূরদর্শিতা প্রয়োগ করে অত্যন্ত সফলভাবে সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করেন।

এ সময়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের যেমন- মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা-প্রত্যাবাসিত-রক্ষিবাহিনী ইত্যাদি অফিসারদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তবে এই সময় মুক্তিযোদ্ধা-প্রত্যাবাসিত সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যকার দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ অনেকাংশে কমে আসে। সে এক অন্য ইতিহাস।

অন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে অফিসার ও সকল পদবির সদস্যদের মধ্যে যে সহজ ও আয়েশী জীবন কাটানো র প্রবণতা চলে এসেছিল, সেটাকে সঠিক পথে আনা। এ ছাড়াও তার বিষয়ে কোন কোন মহলের অনুমিত কিছু নেগেটিভ ধারণাও ছিল। এসব চ্যালেঞ্জসমূহ তিনি তার সুদক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে অতিক্রম করতে সক্ষম হন।

দি প্রোফাইল অব এন আর্মি চিফ :

জেনারেল আতিক মনে করতেন সেনাবাহিনী শুধু পেশা বা সার্ভিস নয়। এটি একটি জীবনধারা- ‘ওয়ে অব লাইফ’। দেশের জন্য ত্যাগই হলো এর মৌলিক উপাদান। তিনি শৃঙ্খলা বিষয়ে আপসহীন, উচ্চাভিলাষহীন আপাদমস্তক একজন পেশাদার সৈনিক ছিলেন। জে. আতিক তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, পেশাগত দক্ষতা ও দূরদর্শিতা প্রয়োগ করে অত্যন্ত সফলভাবে সেনাবাহিনী পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন স্বজনপ্রীতিহীন, ন্যায়পরায়ণ নিরপেক্ষ, সৎ ও নির্লোভ ধরনের সামরিক ব্যক্তিত্ব। ফলে তিনি, উঁচু মনোবলের শক্তি দিয়ে সেনাবাহিনী কমান্ড করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে কোনো গ্রুপিং বা দলাদলিতে মোটেই বিশ্বাস করতেন না।

সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা ছাড়াও উন্নত ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতাবোধ ও চরিত্র শক্তি বলে বলিয়ান ছিলেন। বিচক্ষণ ও প্রবল নীতিবোধ সম্পন্ন এই জেনারেল কথা কম বলতেন কিন্তু কাজ বেশি করতেন। এই সময় কৃচ্ছতা, মিতব্যয়িতার এক ধরনের কালচার গড়ে ওঠে।

একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড, ডিভিশন পর্যায়ে কমান্ড ও সেনাসদর পর্যায়ে (প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে) চাকরির অভিজ্ঞতা জে. আতিককে সফল হতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে অনেক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার দ্রুত পদোন্নতি ঘটে। ফলে সময় ও সুযোগের অভাবে অনেকেই সর্বোচ্চ পদের আগের পদ বা ধাপগুলোতে কাজ করার সুযোগ পাননি। জেনারেল আতিকের মিলিটারি বেয়ারিং, দৈহিক গঠন, দেখতে এবং বেশভূশায় স্মার্টনেস তার ব্যক্তিত্বে আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল।

একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তিনি জেনারেল এরশাদের মতো প্রতাপশালী প্রেসিডেন্টের সময়ে সেনাপ্রধান ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট এরশাদের অত্যন্ত আস্থাভাজনও ছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান হিসেবে নিজ ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুনে জেনারেল ‘এরশাদের শ্যাডোর’ বাইরে নিজের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিলেন জেনারেল আতিক। তবে বেসামরিক পরিসরে এ বিষয়টি তেমন আলোচিত হয়নি। ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ সালে বিভিন্ন কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বহুমুখী প্রতিভার সামরিক ব্যক্তিত্ব তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রমকে (পরে মেজর জেনারেল) চাকরি চ্যুতির নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। কিন্তু সেনাপ্রধান আতিকের দৃঢ়তার জন্য তা শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হয়নি। এ বিষয়ে জেনারেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী লেখেন তিনি (প্রেসিডেন্ট এরশাদ) আবার আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে আর্মি হেডকোয়ার্টারকে লেখেন। আমার সৌভাগ্য বলতে হয়. আর্মি হেড কোয়ার্টার তার প্রথম ও দ্বিতীয় আদেশ কোনোটাই মানেনি। যার জন্য তিনি (প্রেসিডেন্ট এরশাদ) আমার চাকরি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। (১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন)।

এই সময় সেনাবাহিনীতে স্থিতি (স্টাবিলিটি) ফিরে আসে। সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন, সেনা বিদ্রোহ, রাজনীতি ও ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষের বিভীষিকাময় দিন পেরিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেন শুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়েছিল।

ফ্রম মার্শাল ল টু ট্রেনিং গ্রাউন্ড :

একজন দক্ষ গানার অফিসার (আর্টিলারি অফিসার) যেভাবে অসম্ভব সূক্ষ্ম ও নির্ভুল দৃষ্টিতে তার লক্ষ্য (টার্গেট) স্থির করেন, সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পরে জেনারেল আতিকও একইভাবে সুদক্ষ গোলন্দাজ বা গানারের চোখ দিয়ে সেনাবাহিনীর সমস্যা চিহ্নিত করত লক্ষ্য স্থির করেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল মূলত দুটি: শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ।

সেনাপ্রধান হওয়ার পর প্রাধিকার হিসেবে দুটি বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল আতিক : শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ। তার ৪ বছরের সময়ে সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছিল। পরে সেনাবাহিনী এর চমৎকার ফল পেয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেই সময় (১৯৯০) দলগত প্রশিক্ষণ চালু হয়।

একভাবে বলা যায়, জেনারেল আতিকই ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ‘ফুল টাইম’ সেনাপ্রধান। জেনারেল আতিকই প্রথম সেনাপ্রধান যিনি তার পুরো সময়কাল একাগ্রচিত্তে ও নির্বিগ্নে সেনাবাহিনী কমান্ড বা পরিচালনা করেছেন। দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে অফিসার ও সেনাবাহিনীর সব পদবির সদস্যদের মধ্যে কিছুটা সহজ ও আয়েশী জীবন কাটানোর প্রবণতা চলে আসছিল। এ অবস্থা থেকে পুনরায় প্রকৃত সামরিক জীবনধারায় অভ্যস্থ করার মানসে তিনি প্রশিক্ষণ ও শঙ্খলার প্রতি বেশি জোর দেন।

সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের উৎকর্ষতার জন্য প্রশিক্ষণই হচ্ছে মূলমন্ত্র। এটি উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সীমিত সম্পদের মধ্যেও প্রথম থেকেই প্রশিক্ষণের গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। স্বাধীন হওয়ার ২ বছরের মধ্যে (১৯৭৩) বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি ও ৬ বছরের মধ্যে (১৯৭৭) স্টাফ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালে তিন বাহিনী পর্যায়ে ‘এক্সারসাইজ আয়রন শিল্ড’ পরিচালিত হয়েছিল। তবে সামরিক শাসন, অনেকগুলো অভ্যুত্থান, সেনাবিদ্রোহ প্রশিক্ষণের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

জে. আতিক প্রচলিত প্রশিক্ষণের মোডিফাই করেন, নতুন নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন এবং একশক্তিশালী প্রশিক্ষণ কাঠামো তৈরি করেন। এই সময়ে প্রকৃত পক্ষে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের খোলনলচে বদলে যায়। সেনাবাহিনীতে চমৎকার প্রফেশনাল আউটলুক তৈরি হয়।

সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি সরেজমিনে ইউনিট পর্যায়ের প্রশিক্ষণ দেখতে চাইতেন ও ভূমি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড চেক করতেন। সেনাপ্রধান হিসেবে এটি সাধারণভাবে হয়তো প্রত্যাশিত ছিল না। তিনি মনে করতেন, প্রশিক্ষণের মৌলিক বিষয়ে হাত দেয়া উচিত। ইউনিট প্রশিক্ষণ ভিজিটে এলে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের ডিটেইল ও ব্লক সিলেবাস, চেকশিট, সৈনিকদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ইত্যাদি সরেজমিনে যাচাই করতেন ও মিলিয়ে নিতেন। কোনো ক্ষেত্রে ব্যত্যয় বা অবহেলা হলে শাস্তির নির্দেশ দিতেন, যা শুরু হতো ওই মুহূর্তে।

শীতকালীন যৌথ প্রশিক্ষণে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রয়োগ পুঙ্খানুপঙ্খরূপে দেখতেন। ইউনিট অধিনায়করা প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সঠিকতা, যথার্থতা, প্রাসঙ্গিকতা দেখাতে গলদঘর্ম হয়ে উঠতেন। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি স্টেজ-ম্যানেজমেন্ট পছন্দ করতেন না। সেই সময় ইউনিটে সেনাপ্রধান বা চিফের ভিজিট ভীতিকর ঘটনা বা আতঙ্কে পরিণত হয়। সম্ভবত প্রথমবারের মতো সেই সময়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনার গাফিলতি বা ব্যর্থতার জন্য অধিনায়কদের কমান্ড থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়। তবে এই বিষয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু ‘অতিরিক্ত’ হয়েছিল- এমন একটা সমালোচনা সেই সময়ে ছিল। এই সময়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো বিদেশে সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যদের অসংখ্য প্রশিক্ষণ কোর্সের সুযোগ।

জে. আতিক ১৯৮৮ সালের ৩১ জুলাই ময়মনসিংহে অবস্থিত আমার মাতৃ- ইউনিট ২৫ ইস্ট বেংগল এ ট্রেনিং ভিজিটে এসেছিলেন। আমাদের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো আবদুল খালেকের নেতৃত্বে আমরা কয়েক সপ্তাহ প্রচণ্ড পরিশ্রম করে ও এক ভীতিকর সময় পেরিয়ে সেনাপ্রধানের ‘বিখ্যাত’ পরিদর্শন উতরে যাই। ময়মনসিংহ সেনানিবাসের প্রশিক্ষণ মাঠের শুধু সবুজ ঘাস নয়, সৈনিকদের প্রশিক্ষণের খাতাও সেনাপ্রধানের কমান্ড টের পেয়েছিল।

প্রশিক্ষণ সৈনিকের শোনিতপ্রবাহ :

সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সেনা অফিসার ও সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক বানীতে তিনি বলেন- সব সময় সকলের কাছ থেকে আমি উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতা আশা করি। সেনাপ্রধান হওয়ার পর এক দরবারে বলেছিলেন- আমরা গরির দেশ, ভালো অস্ত্র হয়তো কিনতে পারবো না। এই প্রশিক্ষণ দিয়ে পোষাতে হবে। চট্টগ্রামের হালিশহরস্থ আর্টিলারি সেন্টার অ্যান্ড স্কুলের প্রথম গানারি কোর্সের সনদ বিতরনি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন- ‘প্রশিক্ষণ হলো সৈনিকের শোনিতপ্রবাহ এবং এই প্রশিক্ষণ সেনাবাহিনীর জীবন নির্যাস’। এসব বক্তব্য থেকে প্রশিক্ষণের প্রতি তার গুরুত্ব ও আন্তরিকতার বিষয়টি উপলদ্ধি করা যায়।

এই সময়ের সিএএস ট্রেনিং ডাইরেক্টিভগুলোতে সেনাপ্রধানের ‘প্রশিক্ষণ দর্শন’ প্রতিফলিত হয়। জে. আতিকের দীর্ঘ সময়ের পিএস লে. কর্নেল সেলিম আকতার (পরে ব্রিগেডিয়ার জে.) বাংলাদেশ আর্মি জার্নালে ইউনিট ট্রেনিংবিষয়ক একটি চমৎকার আর্টিকেল লেখেন (১৯৮৯)। বলা হয়, তিনি সেনাবাহিনীকে অপ্রয়োজনীয় ও অপেশাগত দায়িত্বের ক্ষেত্র থেকে প্রশিক্ষণের মাঠে ফিরিয়ে এনেছিলেন, শান্তির সময়ে যা সেনাবাহিনীর মূল কাজ।

এই সময়কালে ফর্মেশন/ডিভিশন পর্যায়ে স্টাডি পিরিয়ড, মডেল ডিসকাশন, টিউট ইত্যাদি পরিচালনার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। মডেল রুমে কাল্পনিক যুদ্ধের ঝড় উঠত। প্রত্যেক অফিসারের জন্য ‘বেসিক কমান্ডো কোর্স’ বাধ্যতামূলক করা হয়। যা অফিসারদের শারীরিক যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। চিফ অব আর্মি স্টাফ ট্রফি ফায়ারিং প্রতিযোগিতা ১৯৮৯ সালে চালু হয়েছিল। প্যারা প্রশিক্ষণ কোর্স ১৯৯০ সালে শুরু হয়।

সেনাবাহিনীতে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় এই সময়েই। ১৯৮৭ সালের ০১ জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সেনাবার্তা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনির্বাণ অনুষ্ঠান সাড়া জাগায়। জে. আতিক আভিযানিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে লজিস্টিকসকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রথম লজিস্টিকস এক্সারসাইজ এক্সারসাইজ রঞ্জন রশ্মী অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, এই সময়ে ঢাকায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কয়েকটি সেমিনার যেমন প্যাসিফিক আর্মি লজিস্টিকস সেমিনার (প্যামস) ও প্যাসিফিক এরিয়া সিনিয়র অফিসার্স লজিস্টিক সেমিনার (প্যাসলস) অত্যন্ত চমৎকারভাবে আয়োজন করা হয়েছিল।

১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত ওই প্যাসলস সেমিনারে জেনারেল আতিকের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর লজিস্টিকস্ প্রসঙ্গগুলো চমৎকারভাবে এসেছিল। এই বক্তৃতাটি ১৯৮৯ সালের আমি জার্নালেও প্রকাশিত হয়। এই সেমিনারে থিম ছিল- ট্রেনিং অন দ্যা লজিস্টিক ইন বাংলাদেশ আর্মি। বর্তমানে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি (আইপিএস) নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, ১৯৮০ দশক থেকেই বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী প্যাসিফিক এলাকার সামরিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে।

জেনারেল আতিক সেনাপ্রধান হিসেবে বিভিন্ন কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার সময় সামরিক বাহিনীতে নতুন বেতন স্কেল প্রচলিত হয়। অফিসারগণের পোশাক ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি তিনি স্বল্পমূল্যে ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। এই সময়ে সৈনিকদের বাসস্থানের জন্য তিনি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোশাররফ হোসেন (অব.) এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তার স্মৃতিকথায়।

শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার অপূর্ব মানদণ্ড :

প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তার অগ্রগণ্যতা ছিল কঠোর শৃঙ্খলা। নিজে করে উদাহরণ স্থাপন করতেন অধিনস্তদের কাছে। তার হাত ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রশংসনীয় সুশৃঙ্খল একটি পেশাদারি বাহিনীতে পরিণত হয়। সেনাবাহিনীর সকল পর্যায়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও আপসহীন। সিনিয়র-জুনিয়র কাউকেও তিনি শৃঙ্খলার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না।

দীর্ঘসময়ে জেনারেলের পিএস হিসেবে কর্মরত দক্ষ সেনাকর্মকর্তা লে. কর্নেল সেলিম আকতার (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) একজন কর্মকর্তার শাস্তি পুনঃবিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। জেনারেল আতিক পিএসকে বলেন ‘সেলিম, অবসর গ্রহণের পর আমি তো নির্বাচন করবো না’।

এ বিষয়ে সামরিক বিশ্লেষক, লেখক, সংসদ সদস্য ও কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক (অব.) লিখেছেন ৮৪ সাল থেকে সেনাবাহিনী স্থিতিশীল হয়ে আসে এবং পেশাগত কাজকর্মের উপর গুরুত্ব দেওয়া হলে সাধারণভাবে মনোযোগ ধাবিত হয়। জেনারেল আতিক যখন সেনাপ্রধান তখন মাঠপর্যায়ে পেশাগত কর্মকাণ্ডের প্রতি তথা মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার প্রতি বেশী গুরুত্ব দেয়া হয় (সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর)।

নিজের জীবনে জে. আতিক অসাধারণ এক শৃঙ্খলা ও নৈতিক মানদণ্ড স্থাপন করেছিলেন। নিজেই উদাহরণ সৃষ্টি করতেন। তার এক ছেলে সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য আইএসএসবি এ অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। সেনাপ্রধানের জন্য কাউকে কোন চাপ সৃষ্টি করেননি। ১৯৮৮ সালে সেনাপ্রধানের পিতার মৃত্যু হলে তার মরদেহ সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে ঢাকা সিএমএইচ থেকে লালমাটিয়া নেয়া হয়েছিল। অধিনায়ক, এডমিন উইংকে বিস্মিত করে তিনি পরিবহনের খরচ (অন পেমেন্ট) নিজেই দিয়েছিলেন। অবসরের পর চিকিৎসার জন্য একবার চিকিৎসকরা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন জে. আতিক বলেছিলেন যে তিনি ঢাকা সিএমএইচ এ নিজের চিকিৎসা করাবেন। অন্য কোথাও না। এখন রূপকথার মত মনে হলেও এগুলো সবই সত্য ঘটনা। জে. আতিকের মৃত্যুর পর তার শৃঙ্খলা, সততা, নীতিবোধ ও নির্লোভ জীবনের কথার আর এক স্বাক্ষী রইলো যেন সোশাল মিডিয়া। যখন অবসরপ্রাপ্ত শত শত সেনাকর্মকর্তা প্রয়াত সেনাপ্রধানের জীবনের আলোকিত দিকের উচ্চারণগুলোর আবেগে ভাসবে বন্যার জলের মতো।

জাতিসংঘ শান্তিমিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে শুভসূচনা :

জেনারেল আতিকের সময়ের অন্যতম একটি সাফল্য হলো, প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ শান্তিমিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কিছু বিরোধিতা সত্ত্বেও সেনাপ্রধান জে. আতিক ১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দলকে মিশনে পাঠানোর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সম্মতি ও উৎসাহ অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আলোকেই, ১৯৮৮ সালের আগস্টে তৎকালীন লে. কর্নেল ফজলে এলাহি আকবর (পরে মেজর জেনারেল)-এর নেতৃত্বে ১৫ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা ‘ইউনাইটেড নেশানস ইরান-ইরাক মিলিটারী অবজারভার গ্রুপ’ বা ইউনিমগ মিশনের আওতায় ইরাক গমন করেন।

১৯৯০ সালে ইরাক সফরকালে জাতিসংঘের ইউনিমগ সদরদপ্তরে ভিজিট করেছিলেন জে. আতিক। এই সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান সেখানে সহকারী প্রধান সামরিক পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইউনিমগ সদরদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেদিন বাংলাদেশি সেনাকর্মকর্তাদের (সামরিক পর্যবেক্ষক) কর্মদক্ষতার ভূয়সী প্রসংশা করেন। আবেগ আক্রান্ত সেনাপ্রধান ভাবলেন, সেনাবাহিনীকে পেশাদার করার মেহনত তাহলে ব্যর্থ হয়নি।

যখন চীনের আকাশে :

১৯৮৮ সালে ১৫ দিনের জন্য সস্ত্রীক চীন সফরে গিয়েছিলেন এই সেনাপ্রধান। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাইডেড মিসাইল স্কুলে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু চীন তাকে আরো অভিভূত করে। চীন শুধু দেশ নয়, এ যেন এক ভিন্ন সভ্যতা। বাংলাদেশ ডেলিগেশনের যাতায়াতের জন্য দেয়া হয়েছে একটি বিশেষ বিমান। তাদের সফরসূচিতে রয়েছে: অস্ত্র কারখানা, সেনানিবাস, শিল্প কারখানা, আর্টিলারি গান, সামরিক স্থাপনা, ঐতিহাসিক প্রাসাদ, পর্যটন কেন্দ্র…। তারা গতকাল সফর করেছেন চীনের সবচেয়ে সুন্দর স্থান শহর গুইলিন। সেই শহরের সৌন্দর্য্য এখনো চোখে লেগে আছে।

আজ বিশেষ বিমানে যাচ্ছেন চীনের ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন রাজধানী চংকিং, যা অর্থনৈতিক কেন্দ্র ও প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এরপরের গন্তব্য শিয়ান, যা টেরাকোটা যোদ্ধাদের সমাধি মন্দিরের জন্য মশহুর। চংকিং শহরটি, বেজিং এর ১৫০০ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে বিখ্যাত ইয়াংসি নদীর তীরে অবস্থিত। চীনের গ্রেট ওয়াল, ইয়েলো রিভার, সঙ পর্বতমালা, উপত্যকা, অরণ্য পেরিয়ে উড়ে চলছে বিমান। জেনারেলের পাশে বসে আছেন বেগম মুনিরা আতিক। পেছনের সীটে দুই জন স্মার্ট স্টাফ অফিসার : এডিসি ক্যাপটেন মো. আনোয়ারুল ইসলাম (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) ও এপিএস মেজর মো. শহীদুল ইসলাম (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) ।

তিনি বিমানের জানালার পাশে বসে মেঘ, পাহাড়, অরণ্য, নদীর দৃশ্য দেখার পাশাপাশি ভাবছেন চীন-বাংলাদেশ বিনিময়ের বিষয়গুলো। গত ১০/১২ বছরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চমৎকার অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। চীনের পিএলএ বা পিপলস লিবারেশন আর্মির পেশাদারিত্ব, রণকৌশল, অস্ত্র সম্ভার দেখে সেনাপ্রধান মুগ্ধ হয়েছেন। জেনারেল আতিক লক্ষ্য করেছেন- চীনের অস্ত্র সরঞ্জামাদি পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় কম মূল্যের, সহজ লভ্য , বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে মানানসই, শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সরবরাহ বেশ নির্বিঘ্ন। চীন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর টেক এওয়ে কী কী তা ভাবতে থাকেন এই সেনাপ্রধান…।

সেনাবাহিনী- একটি চমৎকার ফাইটিং ফোর্স :

জেনারেল আতিকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি ভালো ‘ফাইটিং ফোর্স’ এ পরিণত হয়। সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অস্ত্র সরঞ্জামাদি যুক্ত হয়। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল কার্যকর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সামরিক সম্পর্ক। ১৯৮৬-৮৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত শান্তিবাহিনী, দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হলেও সেনাবাহিনী তা নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। ১৯৮৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় অনেকটা জেলা পরিষদের এই কাঠামোকে মূলস্তম্ভ বিবেচনা করে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

একটি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের উৎকর্ষতার মধ্যদিয়েই তার আভিযানিক প্রস্তুতিও চলতে থাকে। জে. আতিকের সময় প্রশিক্ষণ ও অভিযানের বেশ নতুন কিছু ধারণা প্রবর্তন ও আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত যুদ্ধের সঙ্গে অপ্রচলিত যুদ্ধের মিশ্রন, সর্বাত্মক জনযুদ্ধ, প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় অসামরিক ব্যক্তিদের ইন্টিগ্রেশন, সেকেন্ড লাইন ডিফেন্স ফোর্স এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা, নাগরিক ব্যাটালিয়ন… এই সব বিষয় আলোচনা, চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা ও অনুশীলনের গুরুত্ব দেওয়া হতো। ওই সময়ে বাংলাদেশ আর্মি জার্নালে প্রকাশিত উন্নত মানের লেখাগুলোতে এই সব চিন্তাভাবনার প্রতিফলন রয়েছে।

সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের মনোজগতে পরিবর্তন :

জেনারেল আতিকের সময়টি (১৯৮৬-৯০) ছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনের শেষ ৫ বছর। তার শাসনের বিরুদ্ধে তখন বিরোধী দলগুলোর সর্বাত্মক রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল। অন্যদিকে, এই সময়কালেই সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছিল। সেনাবাহিনীতে মার্শাল ল ডিউটি বা এই সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড থেকে প্রশিক্ষণে মনোনিবেশ ঘটছিল। সেনা কর্মকর্তাদের মনোজগতেও বেশ পরিবর্তন আসছিল। এই সব ঘটছিল উচ্চাভিলাষহীন, নির্ভেজাল পেশাদার জে. আতিকের অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বের দৃঢ়তায়। এর সঙ্গে এটাও বিশেষভাবে উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট এরশাদও তখন চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর মধ্যকার এই পরিবর্তনটি অসামরিক পরিসরে বেশ অনালোচিতই থেকে যায়। লেখক ও গবেষক এস মাহমুদ আলী, এ পরিবর্তনের বিষয়টি তার ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ’ বইতে সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।

সেনাকুঞ্জ- আইকনিক এক স্থাপনা :

সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জে. আতিকের সময়ে নির্মিত আইকনিক স্থাপনা হলো সেনাকুঞ্জ। অত্যন্ত উন্নতমানের এই ‘বহুমুখী মিলনায়তন ও সিভিল কমপ্লেক্সটি’ নির্মিত হয়েছিল জে. আতিকের অসাধারণ উদ্যোগে। ১৯৮৯ সালের ২১ নভেম্বর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ‘সেনাকুঞ্জে কিছুক্ষণ’ বইতে কবি নির্মলেন্দু গ‍ুণ সেনাকুঞ্জ নির্মাণে ও জে. আতিকের অবদান ও আবেগ সম্পূক্ততার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

অত্যন্ত পেশাদার সেনাকর্মকর্তা ও লেখক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোশাররফ হোসেন (অব.) ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘যুগ্ম সচিব’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘জীবনের খণ্ডচিত্র, শান্তিতে ও সমরে একজন সৈনিকের স্মৃতিচারণ’ বইতে তিনি জে. আতিকের সময় নেয়া সেনাবাহিনীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, প্রকল্প উল্লেখ করেছেন নির্মোহভাবে। অনেকটা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ইনসাইডার হিসেবে। সেনাকুঞ্জ নির্মাণ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোশাররফ লিখেছেন এই সুন্দর প্রকল্পটির ভাবনা এবং বাস্তবায়ন করেছেন তৎকালীন সেনা প্রধান লে. জে. আতিকুর রহমান। আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ।

মহান মুক্তিযুদ্ধ বক্তৃতামালা ফরমেশন পর্যায়ে উপস্থাপন :

১৯৮৮ সালে সেনাসদর মহান মুক্তিযুদ্ধের অভিযান, ঘটনাবলি সামরিক ইতিহাসের দৃষ্টিকোন থেকে লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সকল ফরমেশনকে (ডিভিশন) তাদের এলাকার সংঘটিত ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে বস্তুতামালা প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেয়। তার ওপর ভিত্তি করে ৪ আগস্ট ১৯৮৮ থেকে ০৮ নভেম্বর ১৯৮৮ পর্যন্ত সমস্ত ফর্মেশন কতৃক সেনাসদরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি ধারাবাহিক বক্তৃতামালা (প্রেজেনটেশন) উপস্থাপন করা হয়। এই বক্তৃতামালার মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিশ্লেষন ভিত্তিক বিবরণী তুলে ধরা হয়েছিল। বলা যায়, এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে বিভিন্ন সেনাপ্রধানের নির্দেশে অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী ‘জাদুঘর’ গড়ে ওঠে এবং মুক্তিযুদ্ধের অঞ্চলভিত্তিক আভিযানিক কার্যক্রম বই আকারে প্রকাশিত হয়।

ব্যক্তিগত জীবন ও ‘গুলজারে রহমত’ :

পেশাগত জীবনে তিনি যেমন সফলতা অর্জন করেছেন, পারিবারিক জীবনেও তিনি গড়ে তুলেছিলেন সুন্দর-শান্তিময় সাবলীল একটি জীবন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি। শান্তিপ্রিয়, নিরহংকার, অমায়িক এক ব্যক্তি। তার রসবোধ ছিল অসাধারন। তিনি ‘প্লেইন লিভিং এন্ড হাই থিংকি’ এ বিশ্বাস করতেন। তিনি গান খুব ভালোবাসতেন। তার শখ ছিল বাগান করা। তার প্রিয় ফুল ছিল গোলাপ। বনানিতে বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘গুলজারে রহমত’ (রহমতের বাগান)।

পূর্ণাঙ্গ অবসরের গল্প :

সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণের পূর্বে বিদায়ী বানীতে জেনারেল আতিক বলেন- এ কথা ঠিক যে আমি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিচ্ছি। যেখানে থাকি না কেন আপনাদের মাঝে কাটানো ৩৯টি বছরের স্মৃতি সব সময়ই আমার হৃদয়ের গভীরে সযত্নে রক্ষিত ও লালিত হবে।’

তিনি অবসর গ্রহণের পর কোনো ধরনের চাকরি বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বা রাজনীতিতে জড়াননি। একজন সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি নিজের মানসম্মান ও মর্যাদার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এটি ছিল তার পূর্ণাঙ্গ অবসর। তার কর্মকাণ্ড ছিল সত্যিকারের সৈনিকসূলভ। ‘ওয়ানস এ সোলজার অলঅয়েজ এ সোলজার’- কথাটা যেন তার জন্যই প্রযোজ্য। অবসর গ্রহণের পর সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সেনানিবাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশেষত ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জানাযায় তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ ওই মসজিদে আদায় করতেন। ঝকঝকে নতুন ও বড় গাড়ির ভিড়ে জেনারেল আতিক তার পুরোনো সাদা রংয়ের টয়োটা করোলা ডাবলই নাইনটি মডেলের গাড়ি করে মসজিদে আসতেন। জেনারেল আতিকের মৃত্যুর পর তার সৈনিকসূলভ, মর্যাদাবান, সহজ ও নির্লোভ জীবনযাপনের কথা স্মরণ করেন তার একসময়ের এপিএস লে. কর্নেল মো. আইনুল আজিম (অব.)।

লেখালেখির খোলা আকাশ :

জেনারেল আতিক ছিল অত্যন্ত প্রচার বিমুখ। অবসর গ্রহণের পর মিডিয়া থেকে সবসময় দুরে থাকতেন। কখনো লাইম লাইটে আসতে চাইতেন না। এই বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সেনানায়কের প্রকাশিত লেখা খুবই কম। তিনি ২০২০ সালে ‘রাওয়া মিরর’ পত্রিকায় ‘মেজর আবদুল গনি : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তার অবদান’ শীর্ষক একটি ছোট্ট অথচ চিন্তাউদ্দীপক প্রবন্ধ লেখেন।

মেজর আবদুল গনি ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের’ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্মানিত। এই প্রবন্ধে জে. আতিক তুলে ধরেছেন কীভাবে কিংবদন্তিতুল্য মেজর গনি বাঙালি তরুণদের সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে যোগদানের জন্য মোটিভেট করেছেন ও আহবান জানিয়েছেন। মেজর গনি বাঙালি অভিভাবক ও তরুণদের মন থেকে ‘সেনা আতঙ্ক’ চিরতরে দূর করেছেন। জে. আতিকের মতে, এটিই ছিল মেজর গনির সবচেয়ে বড় অবদান। এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসাধারণ ভূমিকা ও মেজর গনির অবদান সম্পর্কে নতুন এক ধারণা দিয়েছেন ও মূল্যায়ন করেছেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘প্যাসিফিক এরিয়া সিনিয়র অফিসার্স লজিস্টিকস সেমিনার’ (প্যাসোলস)-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জে. আতিক বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃায় বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর লজিস্টিকস্ প্রসঙ্গগুলো চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। এই বক্তৃতাটি ১৯৮৯ সালে আর্মি জার্নালে প্রকাশিত হয়।

সামরিকবিষয়ক লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) ২০২০ সালে জেনারেল আতিকের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পরে এর ওপর ভিত্তি করে কর্নেল হক জেনারেল আতিকের ওপর ‘অত্যন্ত সফল একজন সেনাপ্রধানের গল্প’ শীর্ষক প্রবন্ধ লেখেন। এটি প্রথম তার ফেসবুকের টাইমলাইনে প্রকাশিত হয় (৩১ আগস্ট, ২০২০)। এই অসাধারণ লেখাটি পরে দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়া দিগন্ত ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

বিডিআর এর ডিজি ও সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল আতিক এর বাংলাদেশের নিরাপত্তা উন্নতি কল্পে অসাধারণ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা, রণনীতি, কৌশল নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন জেনারেল আতিক। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে ‘ডেটারেন্স’ অর্জন করতেই হবে। সাংবাদিক, গল্প লেখক আবু রূশ্দ-এর লেখা ‘জাতীয় নিরাপত্তা রণনীতি ও সশস্ত্রবাহিনী’ শীর্ষক বইতে জেনারেল আতিকের একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে। এই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সশস্ত্রবাহিনী, প্রতিরক্ষানীতি ও রণনীতি নিয়ে তার ভাবনার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। যতদূর জানা যায়, তিনি তার সামরিক জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ওপর জীবনীগ্রন্থ ধাচের একটি বই লিখছিলেন। তিনি চাইতেন বইটি তার মৃত্যুর পর তা প্রকাশিত হোক। বইটি কবে আলোর মুখ দেখবে?

মিট অ্যান্ড গ্রিট অনুষ্ঠান- শেষবারের মতো সেনাকর্মকর্তাদের সান্নিধ্যে :

গত ২ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে রাওয়া ক্লাবের সুসজ্জিত হেলমেট হলে জে. আতিকের সম্মানে তার জন্মদিন উপলক্ষে ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মূলত অবসরপ্রাপ্ত আর্টিলারি অফিসারগণ এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে সম্মান জানিয়েছিলেন। হেমন্তের সেই সন্ধ্যায় একে একে সবাই আসবার পর অনুষ্ঠানে এলেন জীবন্ত কিংবদন্তি জেনারেল আতিক- ধবধবে ফর্সা চেহারা, তুষারশুভ্র চুল, পরনে কালো স্যুট, সাদা-কালো স্ট্রাইপ শার্ট ও আর্টিলারির রেজিমেন্টাল টাই। ওনার বয়স তখন প্রায় ৯৩। জেনারেল আতিককে বেশ ক্লিশকায় দেখালেও ওনার ব্যক্তিত্বের দ্যুতি তখনও উপচে পড়ে। স্বাগত বক্তব্য, স্মৃতিচারণ, স্মারক প্রদান ও কেক কাটা পর্বের পর এলো সাবেক সেনাপ্রধানের বক্তব্য। বক্তৃতার শুরুতে, তিনি রসিকতা করে উদ্ধৃত করলেন আমাদের অন্যতম জাতীয় নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর এক বচন : ‘ইংরেজরা করেছে শাসন, পাকিস্তানিরা করেছে শোষণ, আর বাঙালিরা করে শুধু ভাষণ’। সেই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় উঠে আসে তার জীবন দর্শন, অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল সৈনিক জীবন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী নিয়ে ভাবনা, কনিষ্ঠদের প্রতি কল্যাণ কামনা ও একগুচ্ছ উপদেশমালা…।

সময়ের কষ্টিপাথরে বিলম্বিত যে মূল্যায়ন :

১৯৭০-৮০ দশকে সম্পদের অভাবের কারণে সেনাবাহিনীতে আজকের মত চোখ ধাঁধানো ভৌতিক অবকাঠামোগত তখন গড়ে ওঠেনি। তবে জে. আতিকের সময় সেনাবাহিনীর চারিত্রিক ও আত্মিক গর্বময় একটা চমৎকার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল…। এমন আলোচনা এখন বেশ হচ্ছে। একজন সেনাপ্রধান বা যে কোন ব্যক্তির নির্মোহ মূল্যায়নের জন্য কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়া প্রয়োজন। কালের প্রবাহে পাথর খণ্ডে শেওলা জমে। কিন্তু কর্মের উজ্জ্বল্যে সেই পাথর থেকে দ্যূতি ঠিকরে পড়ছে সমান তালে। জে. আতিক তেমনই অতুজ্জ্বল একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব। যিনি ৩৩ বছর আগে অবসরে গেলেও নিজ নেতৃত্ব ও কর্মগুণে তার ভাবমূর্তি দিন দিন উজ্জ্বল হয়েছে।

পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতার দিক দিয়ে জেনারেল আতিক ছিলেন যেন একটি বাতি ঘর। সেনা কমান্ডাররা যা অনুসরণ ও অনুকরণ করতে পারেন। তিনি রেখে গেলেন নেতৃত্বের অনন্য নজির।

জে. আতিকের কমান্ড স্টাইল ছিল- ‘কুল অ্যান্ড ফার্ম’। সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের সদস্যদের জন্য তার ছিল বুকভরা আবেগ, ভালোবাসা ও প্রীতি। কিন্তু কখনও তা প্রকাশ করতেন না। এটা ছিল তার নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে, তার প্রতি সেনাকর্মকর্তা ও সৈনিকদের ছিল দূর থেকে কিছুটা ভয় মিশ্রিত গভীর শ্রদ্ধা।

পেশাদার সৈনিক হিসেবে জেনারেল আতিক গণতন্ত্র, সংবিধান ও আইনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এটি বিশেষভাবে, উল্লেখ্য, সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে তিনি একটি পেশাদার পরিবেশ তৈরির আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। সেই ধারাটি পরবর্তীতে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল।

একাত্তর রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এম এ মতিন, বীর প্রতীক, পিএসসি (অব.), সেনাপ্রধান জেনারেল আতিকের নেতৃত্ব ও কমান্ড সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন, অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ও ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হিসেবে। জেনারেল আতিকের বিষয়ে তার মূল্যায়ন তাই অত্যন্ত প্রণীধানযোগ্য। তিনি লিখেন ‘৮৬/৮৭ সালে শুধু মেজর জেনারেল নয় বরং সেনাবাহিনীর অন্যান্য সিনিয়র পদ ও পদবিতে পদোন্নতি ও নিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাইরের প্রভাবমুক্ত ছিল, তথাকথিত দলীয়করণ বা সরকারিকরণ নীতির সর্বনাশা প্রভাব এখনো পর্যন্ত পড়েনি…।

জেনারেল আতিক সেনাপ্রধান হিসেবে বহাল থাকাকালীন এ সেনাবাহিনীতে একদিকে যেমন ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলাবোধ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল অপর দিকে তেমনি পদোন্নতির ক্ষেত্রে সর্বস্তরের জন্য পেশাদারিত্বই যোগ্যতা নিরুপনের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সেনাপ্রধান জেনারেল আতিকুর রহমানের সুদক্ষ নেতৃত্ব ও পরিচালনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দৃঢ় পদক্ষেপে সম্মুখ পানে এগোতে থাকে। একজন অতিসফল, দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও ন্যায়পরায়ণ সেনাধ্যক্ষ হিসেবে জেনারেল আতিকের নাম তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে…….’। (আমার দেখা ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ’৯৬)

জেনারেল আতিকের পেশাদারিত্ব, সততা ও অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট ও ঢাকা ট্রিবিউন এর কনসালটেন্ট এডিটর, সৈয়দ বদরুল হাসান ‘He demonstrated professionalism expected of a true soldier. Hardly anything of the negative was associated with his career. Not in his character was noted any hint of inordinate ambition…, Atiqur Rahman served the army well, and through doing that he let it be known that the institutions of the state, of which the armed forces were one, were there to uphold the rule of law, indeed the constitution, for that was their prime responsibility.

…But such questions were overshadowed by General Atiqur Rahman’s performance as chier of staff of the army.

General Atiqur Rahman will be remembered for the stability he brought to the army after the many convulsions it went through before he took over as chief of staff. Basic honesty underlined his attitude to life, buttressed by his deep religiosity. (Obituary, Lt. Gen. M Atiqur Rahman, Dhaka Tribune, 24 December 2023).

অনেক আগের কথা। একবার ঢাকা সেনানিবাসের কোরো অফিসে তার সঙ্গে সামরিক জীবন ও সেনাবাহিনীর কিছু বিষয় নিয়ে আমরা কজন কথা বলছিলাম। একপর্যায়ে সাহস নিয়ে বললাম- ‘স্যার, আপনার জীবন দর্শন, আদর্শ নিয়ে কোনো লেখা কি আমরা পাবো না? জেনারেল আতিক উত্তরে হেসে বললেন- ‘দেখ, আমি চেষ্টা করেছি সৈনিকসূলভ একটা সাধারণ জীবন যাপনের’। তখন মহান মহাত্মা গান্ধীর একটা কথা আমার মনে পড়েছিল- ‘মাই লাইফ ইজ মাই ম্যাসেজ’। সত্যিই, জেনারেল আতিক অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এক জীবনযাপনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের সৈনিকদের জন্য অনন্য উদাহরণ রেখে গেলেন। তিনি সম্ভবত একজন অন্যতম ‘রোল মডেল’ সেনাপ্রধান হিসেবে সেনাবাহিনীতে সম্মানিত থাকবেন।

সেনাবাহিনী নেতৃত্ব ও এক অনবদ্য রিলে রেস :

লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাপ্রধানের ব্যাটন দিয়েছিলেন লে. জেনারেল আতিককে। আবার ৪ বছর পর লে. জেনারেল আতিক সেনাপ্রধানের ব্যাটন হস্তান্তর করলেন পরবর্তীতে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নূরউদ্দিন খানকে। রিলে রেসের মতো এভাবেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এগিয়ে যায়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে। জেনারেল আতিকের ধারাবাহিকতায় আমাদের পরবর্তী সেনাপ্রধানরাও তাদের গতিশীল নেতৃত্বের ছাপ রেখেছেন। যার ফলেই আজ দেশে বিদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসাধারণ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। জে. আতিক ছিলেন পাকিস্তানের ৯ম পিএমএ লং কোর্স-এর একজন অফিসার। আমাদের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ম বিএমএ লং কোর্সের একজন অফিসার। একটি চমৎকার কো-ইনসিডেন্ট বটে।

বিদায়ী অভিবাদন- ‘দি লাস্ট পোস্ট’ :

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসাধারণ সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিল তার এক সময়ের দিকপাল সেনাপ্রধানকে। বনানী সামরিক কবরস্থানে ২০ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিলিটারি ফিনারেল বা দাফনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। জাতীয় পতাকায় ঢাকা জে. আতিকের কফিন একটি গান ক্যারেজে রাখা হয়।

সামরিক ঐতিহ্য অনুযায়ী, সেরিমনিয়াল পোশাক করা ৪ জন মেজর জেনারেল ‘পল বেয়ারার’ হিসেবে ধীর গতিতে মার্চ করে কফিন রাখার ক্যারেজটি নিয়ে এগিয়ে যান। উল্লেখ্য, বেগম মুনিরা আতিক ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবরের পাশেই সমাহিত হচ্ছেন জে. আতিক। মরদেহ কবরে নামানো ও দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর ২৫ ইস্ট বেঙ্গলের (মৃত্যুঞ্জয়ী পঁচিশ) একটি চৌকস সেনাদল ভলি ফায়ার (গান স্যালুট) প্রধান করে। এই পদাতিক ইউনিট বা পল্টনটি ফিনারেলের দায়িত্বে রয়েছে।

সবশেষে, সেনাবাহিনীর এই সম্মানগার্ড মরণোত্তর সালাম (আর্মস ডাউন) প্রদান করলো। বিউগলের করুন সুরে এভাবেই শেষ বিদায় (লাস্ট পোস্ট) জানানো হলো জেনারেল আতিককে। ১৯৩১ সালের ০১ সেপ্টেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদের খারেরা গ্রামে জীবনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ তা শেষ হলো বনানিতে এসে।

সূর্য ঢলে পড়েছে। জে. আতিক গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসতেন। পিলখানায় ‘বিখ্যাত গোলাপ’ বাগান তার সময়েই গড়ে ওঠে। জানা যায়, মাসান্ডা ফুল তিনি বার্মা থেকে আনিয়েছিলেন। তা আজ সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেনানায়ক জে. আতিকের সৈনাপত্য, অধিনায়কত্ব, পেশাদারিত্ব ও সৈনিকসুলভ অসাধারণ গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো গোলাপ ফুলের মতোই সৌরভ ছড়াবে চতুর্দিকে। সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জে. আতিকের মতো সেনানায়কদেরই খুঁজে নেবে অবলীলায়। তার নেতৃত্বের প্রাসঙ্গিকতা বিশেষত পেশাদারিত্ব হয়তো আগামী দিনেও থাকবে। জেনারেল আতিক আপনাকে বিদায়ী অভিবাদন। স্যালুট টু ইউ স্যার। পরম করুনাময় আল্লাহ্ আপনাকে বেহেশত নসিব করুন।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।