প্রচ্ছদ বাংলাদেশ একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

বাংলাদেশ: “কোনো পুরুষ ছাড়া মেয়েদের একা ঘুরে বেড়ানোকে এখনও মানুষ সহজভাবে নিতে পারে না,” বলছিলেন এক নারী পর্যটক।

ছোটবেলা থেকেই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন বুনতেন সাবিরা মেহরিন। বছর দশেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়াশোনার সময় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০১৪ সালে একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সাবিরা। কিন্তু বাধ সাধে পরিবার, তারা মেয়েকে ‘একা’ বাইরে পাঠাতে নিরাপদবোধ করছিলেন না। যদিও সাবিরার ছেলে বন্ধুরা সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। তার মতো যাতে কারও আক্ষেপ না থাকে, সেই ভাবনা থেকে ২০১৭ সালে ফেইসবুকে খোলেন ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ গ্রুপ। “জীবনে আসা প্রথমবার একটি বড় সুযোগ ছেড়ে দেওয়া, নারীদের ভ্রমণ নিয়ে বদ্ধমূল ধারণা ও নিরাপত্তা নিয়ে পরিবারের চিন্তা- এই তিন বিষয়ই নারীভিত্তিক ভ্রমণ গ্রুপ ওয়ান্ডার ওম্যান প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন ওয়ান্ডার ওম্যানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সাবিরা মেহরিন। নারীদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিতে এমন আরও গ্রুপ আছে দেশে, যাদের ওপর ভরসা রাখছেন অনেকেই।‘ভ্রমণকন্যা-ট্র্যাভেলেটস অব বাংলাদেশ’, ‘ফ্লাই ফার লেডিস’, ‘লেডি ট্রাভেলার্স বাংলাদেশ’ এমনই সব গ্রুপ, যারা নিয়মিতভাবে ‘ট্যুর’ আয়োজন করে চলেছে কয়েক বছর ধরেই।

একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

২০১৮ সালে এমন গ্রুপে যুক্ত হয়ে ইতোমধ্যে গোটা ত্রিশেক ‘ট্যুর’ দিয়ে ফেলেছেন নাসিম জোহরা লীরা। বললেন, তার প্রথম ‘ট্যুর’ ছিল বরিশালের পেয়ারা বাগানে, গিয়েছিলেন দলেবলে। আজকাল অবশ্য নিজের ব্যবসার কাজে একাই চলে যান দেশ-বিদেশ। “কোনো পুরুষ ছাড়া মেয়েদের একা ঘুরে বেড়ানোকে এখনও মানুষ সহজভাবে নিতে পারে না। মেয়েদের ভ্রমণকে ইতিবাচকভাবে দেখা তো দূরের কথা, দেখেন বাঁকা চোখে। “অনেক বন্ধু আছে, যারা শুধুমাত্র একা ঘোরাঘুরি করার কারণে আমার সঙ্গে যোগাযোগও রাখেনি।” এদের মতো আরও এক ভ্রমণ পাগল নাজমিন লাবণী, যার ইচ্ছে দেশের সব কয়টি জেলা ঘুরে দেখা। ৫৫টির মতো জেলা ইতোমধ্যে ঘুরেও ফেলেছেন। তার এই ভ্রমণ শুরু ২০১৬ সালে, নারীদের গ্রুপে বেড়াতে যাওয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা ছিল না মনে। তবে নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া এখনও সহজ নয় বলেই মনে করেন লাবণী। “এক গ্রুপে ৪০ জন নারী থাকলেও ঘুরতে গিয়ে অনেক মানুষের কাছেই শুনতে হয়েছে, ‘আপনারা একা একা ঘুরতে এলেন কেন?’ তবে আশার কথা হলো, গত কয়েক বছরে নারী পর্যটকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।”

একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

অবশ্য ‘ট্যুর গ্রুপ’ সম্পর্কে যে বেশির ভাগ নারীই ওয়াকিবহাল- এমন নয়। সেই কারণে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারেননি অনেকেই। এমনই একজন রেজওয়ানা চৌধুরী, যিনি বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পরিবার থেকে বাবা, ভাই বা স্বামী ছাড়া ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি কখনই দেওয়া হয়নি। আর একা আশপাশে কোথাও ঘুরতে যাবেন, সেই সাহসও করতে পারেননি।  “সোশাল মিডিয়ায় কিছু পেইজের নাম দেখেছি, কিন্তু বিস্তারিত জানি না। তবে গ্রুপগুলো যদি নির্ভরযোগ্য হয়, আর নিরাপত্তা দিতে পারে; তবে ভ্রমণের ইচ্ছা পূরণের একটা পথ পাব,” বলছিলেন রেজওয়ানা। তার মতো সংসার করলেও ঠিক ভিন্ন গল্প শোনা গেল গৃহিণী সামিয়া আক্তারের মুখে। ৪০ পেরোনো এই নারী স্বামী, দুই সন্তান আর পরিবারকেই সময় দিয়ে থাকেন। এরইমধ্যে ‘সাহস’ করে এক বান্ধবীর সঙ্গে নারী গ্রুপের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন তিনি।  সামিয়া বলছিলেন, “নিজের জন্য সময় বের করা, ঘুরতে বের হওয়া- খারাপ কিছু নয়। এতে পরিবারের প্রতি কেউ দায়িত্বহীন হয়ে পড়ে না; বরং পরিবারের সদস্যদেরই উচিত নারীদের ভ্রমণে উৎসাহিত করা।”

কত নারী ‘ট্যুর গ্রুপে’

নারীদের ভ্রমণের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘ভ্রমণকন্যা-ট্র্যাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ যাত্রা করে ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর। এ গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাকিয়া হক ও মানসী সাহা দুজনেই পেশায় চিকিৎসক মেডিকেলের শিক্ষার্থী থাকাকালীন দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যেতেন এ দুই বান্ধবী। তবে শুরুর পথটা যে খুব মসৃণ ছিল না- তা নয়। থাকা-খাওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে আসে। সাকিয়া-মানসী ভাবলেন, যদি একটা গ্রুপ করা যায় তাতে অন্তত কিছু সমস্যা কাটানো যাবে। মাত্র সাতজন দিয়ে শুরু করা সেই গ্রুপে প্রায় এক হাজারের মতো সদস্য হয় মাস তিনেকের মধ্যে।

একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

এই সহস্র নারীর মধ্যে জনা তিরিশেক সদস্য নিয়ে নরসিংদীতে সরিষা ফুল দেখতে যান ‘ভ্রমণকন্যা’রা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি; বর্তমানে গ্রুপটিতে সদস্য আছেন প্রায় ৭৮ হাজার নারী। ভ্রমণকন্যার সহ-সভাপতি মুশফিকা রহমান নিঝুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ২২৫টি সফল ট্যুর আয়োজন করতে পেরেছি আমরা। যার মধ্যে দেশের বাইরে এশিয়ার কয়েকটি দেশে হয়েছে ৭টি ট্যুর। “সব মিলিয়ে নারী ভ্রমণকারীদের সংখ্যাও কম নয়। এখন পর্যন্ত সাড়ে ১০ হাজারের বেশি নারী দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেছেন আমাদের সঙ্গে।”

ঈদের ছুটিতে কাদের কী আয়োজন

ঈদের ছুটিতে নারীদের নিয়ে ভারতের কাশ্মীরে ভ্রমণ আয়োজন করেছে ‘ভ্রমণকন্যা-ট্র্যাভেলেটস অব বাংলাদেশ। আরেক দল নারী জাপানে যাচ্ছেন ‘ওয়ান্ডার ওম্যানের’ হাত ধরে। গ্রুপটির মাধ্যমে ৩৫ জন নারী ঈদের অবকাশ কাটাবেন শ্রীলঙ্কা, লাদাখ, নেপাল ও ভিয়েতনামে। দেশে সাজেক ভ্যালিতে ঈদ ভ্রমণের আয়োজন করেছে ফ্লাই ফার লেডিস। এছাড়া মারমাদের বর্ষবিদায় ও বরণ অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য ভ্রমণ আয়োজন করেছে তারা। আর দুবাই ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে লেডি ট্রাভেলার্স বাংলাদেশের তরফে।আর সাবিরা মেহরিনদের গ্রুপ ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইতোমধ্যে প্রায় ১১ হাজার নারী দেশ ও দেশের বাইরে ভ্রমণ করেছেন। এই যাত্রায় মাঝবয়সী পেশাজীবী নারীরা যেমন আছেন, তেমনই স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারাও আছেন। সাবিরা জানালেন, বিভিন্ন বয়সী নারী থাকলেও তরুণীরাই বেশি তাদের সঙ্গে ভ্রমণে যান। প্রথম ভ্রমণ ছিল গাজীপুরে, ১০০ জন নারীকে নিয়ে ডে লং ট্রিপ। আর দেশের বাইরে প্রথম ‘ট্যুর’ ছিল ভুটানে। ১৮ জন নারীকে সেই যাত্রায় তিনটি শহর ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিল। এর বাইরে ওমান, মরক্কো, জর্ডান, উজবেকিস্থান, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ আয়োজন করেছে ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’।

কেবল ভ্রমণই নয়…

কেবল ভ্রমণ আয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ‘ভ্রমণকন্যা-ট্র্যাভেলেটস অব বাংলাদেশ’। ‘ভালো কিছু’ করার ভাবনা থেকে ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল দুটি স্কুটি নিয়ে চার নারী বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন জেলায়। ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ শিরোনামের সেই যাত্রা কেবল ঘুরে বেড়ানোতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা প্রতিটি জেলার দু-তিনটি করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কর্মশালা বা আলোচনাসভার আয়োজন করেন। তাতে পর্যটন ও মুক্তিযুদ্ধ, খাদ্য-পুষ্টি ও পরিবেশ, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা ও আত্মরক্ষার মতো বিষয়ে মুক্ত আলোচনা করা হয়। প্রায় দুই বছরে ৬৪টির বেশি স্কুলে চলে ভ্রমণকন্যার ওই আয়োজন।

একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

ভ্রমণকন্যার সহ-সভাপতি নিঝুম বলেন, “বর্তমানে ৫ বছরের জন্য জিপ (জেন্ডার ইকুইটি অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম) নামের একটি প্রকল্প চালু আছে। প্রতিমাসে দেশের ৮টি বিভাগের দুটি স্কুলে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। “এসব স্কুলে ১ হাজার ৫৪ জন ছাত্রী এবং সারা দেশে জিপের ১ হাজার ২০০ জন নারী ভলান্টিয়ার ঘোরাঘুরির পাশাপাশি এই প্রকল্পে অংশ নেন।” এসবের বাইরে ‘ভ্রমণকন্যার ঘর’ নামে ঢাকায় ডরমিটরি বা আবসান সুবিধাও দিয়ে আসছে গ্রুপটি। ঢাকার বাইরে থেকে আসা নারীরা নামমাত্র মূল্যে থাকতে পারেন সেখানে। এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি নারী বিভিন্ন প্রয়োজনে থেকেছেন ‘ভ্রমণকন্যার ঘর’-এ।

দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে?

‘ভ্রমণে নারীদের নিরাপত্তা কম, তার সঙ্গে আছে নানা ধরনের ঝামেলা’ এমন মন্তব্য হরহামেশায় শোনা যায়। এ আশঙ্কা থেকে ভ্রমণে আগ্রহী হলেও ঘর ছেড়ে বের হন না অনেকে নারীই। আবার অনেকে সাহস করে বেরিয়ে পড়েন অন্যদের সঙ্গে। তবে ‘গ্রুপ ট্যুর’ হলেও অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর বা স্বস্তিদায়ক হয় না।

একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

ভ্রমণকন্যার নিঝুমের কথায়, একসঙ্গে কয়েকশ নারী ভ্রমণে বের হলেও খারাপ অভিজ্ঞতার ‘কমতি’ হয় না।রাঙামাটির বিলাইছড়ির একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেই ট্যুরে ৪৫ জন নারী ছিলেন। কোনো পুরুষ না থাকায় আমাদের একটি এলাকায় ঝরনা দেখতে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। তবে তাতে থেমে যাইনি আমরা। “পরেরবার কোনো পুরুষ ছাড়াই যাবতীয় অনুমতি নিয়ে সেই ঝরনা ঘুরে এসেছিলাম। এছাড়া সেন্টমার্টিন ট্যুরে একজন পুরুষ অনুমতি ছাড়াই আমাদের গ্রুপের নারীদের ভিডিও করেছিল। বিষয়টি বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছিল।”  টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে গিয়ে বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার কথা জানান ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’র সিইও সাবিরা মেহরিন। তিনি বলেন, “প্রায় ১৫ জন নারীর সেই ট্যুরে বোটে ছিলেন ৩৫ জন পুরুষও। তাদের মধ্যে একজন নারীদের নানাভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করে। পরে ঢাকায় ফিরে সেই ব্যক্তিকে পুলিশের সাহায্য জেল ও শাস্তির আওয়তায় আনা হয়। “এমন অনেক বাধা থাকলেও নারীরা একাই ভ্রমণে আগ্রহী। তবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও খুব দরকার। তাহলেই পুরুষের মতো নারীদেরও ভ্রমণের আগে এতো ভাবতে হবে না।”

একা একা ঘুরতে এলেন কেন? যে প্রশ্ন শুনতে হয় নারীদের

ভ্রমণকন্যা বলছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যাওয়া অনেক নারীই নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। সেই সমস্যার সমাধানে নারীদের জন্য ‘বেহুলা’ নামে একটি হাউজ বোট তৈরি করেছে গ্রুপটি। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ৮৫টি বোটের মধ্যে এই একটি বোটই কেবল নারীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ বোটটি তৈরিতে বিনিয়োগ, পরিচালনা- সবই করেছেন নারীরা।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।