রাজনৈতিক : ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে জাতীয় পার্টির দৃশ্যপট। দলটির অন্দরে চলছে নানা সমীকরণ। জাতীয় নির্বাচনের পর নয়া সমীকরণে দলটি। ভোটে দুরবস্থা, সরকারের সঙ্গে সমঝোতাসহ নানা বিষয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা বেড়েছে। এমনকি দলের এমপি প্রার্থীদের অনেকে দলীয় রাজনীতি নিয়ে দোটানায় পড়েছেন।।
কেউ কেউ এলাকায় নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে পারছেন না। নির্বাচনের পরপরই এমন ক্ষোভ-বিক্ষোভের জেরে দল থেকে বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন সিনিয়র নেতাও আছেন। সামনে আরও অনেকে বহিষ্কৃৃত হতে পারেন এমন হুঁশিয়ারিও দিয়ে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বহিষ্কৃত ও দলীয় সিদ্ধান্তে হতাশ নেতাকর্মীরা একজোট হওয়ার চেষ্টা করছেন।
তাদের অনেকে রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কারণ নির্বাচনে কৌশলে রওশন এরশাদপন্থি নেতাদের কোনঠাসা করা হয়েছিল দলের তরফে। এই পক্ষের কেউ নির্বাচনেও দলীয় ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। এমন অবস্থায় ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত নেতাকর্মীরা ফের রওশন এরশাদকে সামনে আনতে চাইছেন। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু তারা বলছেন না। নেতাদের দাবি বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির অস্থিত্ব ধরে রাখা কঠিন।
সর্বশেষ গতকাল গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে দলে ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন রওশন এরশাদ। একইসঙ্গে বহিষ্কৃত নেতাদের সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। হঠাৎ রওশন এরশাদের এই বিবৃতি নিয়ে দলে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। নেতাকর্মীরা বলছেন, দলে নয়া মেরূকরণের অংশ হিসেবেই রওশন এই বিবৃতি দিয়েছেন। সামনে তাকে ঘিরে জাপায় নতুন বলয় তৈরি হতে পারে।
রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যেসব নেতাকর্মী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের দল থেকে বহিষ্কার বা অব্যাহতি প্রদান অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তথাকথিত দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের ভঙ্গুর অজুহাত তুলে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কার করা অত্যন্ত দুঃখজনক।
একই সঙ্গে অনতিবিলম্বে অব্যাহতি পাওয়া ও বহিষ্কৃত নেতাকর্মীদের দলে ফিরিয়ে এনে স্ব স্ব পদে বহালের আহ্বান জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, যে মুহূর্তে সব স্তরের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে নির্বাচনে বিপর্যয় এড়িয়ে দলকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন, সেই মুহূর্তে নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের দল থেকে বের করে দিয়ে দলকে ন্যাপ মোজাফফর, ন্যাপ ভাসানী ও মুসলিম লীগে রূপান্তরের শামিল। তাই অনতিবিলম্বে দলকে ঐক্যবদ্ধ করার সব প্রয়াস গ্রহণের জন্য পার্টির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ওদিকে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা অনেকে দলের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত একজন নেতা বলেন, আমরা ধীরে ধীরে গৃহপালিত দল থেকে গৃহ বিতাড়িত দলে পরিণত হচ্ছি। আগের নির্বাচনে তারা (আওয়ামী লীগ) ২৬ জনকে জায়গা দিয়েছিল। এবার এই সংখ্যা অর্ধেকের থেকেও নিচে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু আমাদের নেতারা ঠিকই নিজেদের আসন নিয়ে নিয়েছেন। স্ত্রীর জন্য আসন নিয়ে শেষ পর্যন্ত দেনদরবার চালিয়ে গেছেন।
নির্বাচন করে পারজিত হওয়া এই প্রার্থী আরও বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন দলকে বাঁচিয়ে রাখতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান নেতা প্রয়োজন। আমরা রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সম্মেলন করেই হোক বা যেকোনো পন্থায় জিএম কাদের ও চুন্নুকে হঠাতেই হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেকেই এখন কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকেই সারাজীবন জাতীয় পার্টিতে সময়, মেধা, শ্রম বিনিয়োগ করে আসছেন। এখন বহিষ্কার করা হচ্ছে ঠুনকো কারণে। এখন বহিষ্কার হলে হয়তো তার সারাজীবনের বিনিয়োগটাই নসাৎ হয়ে যাবে। এই কারণেই প্রকাশ্যে কথা না বললেও ভিতরে তারা ক্ষিপ্ত। এখন আমাদের ব্যাটেবলে মিলে গেলে আমরা রওশন এরশাদকে নিয়ে এগিয়ে যাবো। তবে আমরা চাই গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের হটাতে। যদিও ম্যাডামের বয়সের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হচ্ছে।
সদ্য বহিষ্কার হওয়া এক নেতা বলেন, আমাকে বহিষ্কারের পর আমি কিছুটা বিস্মিতই হই বটে। সিদ্ধান্ত নেই রাজনীতিই আর করবো না। যেহেতু এটা আমার একমাত্র পেশা নয়। এরপর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ম্যাডামের (রওশন এরশাদ) ঘনিষ্ঠ এক নেতা। এখন চিন্তা করছি বিষয়টি নিয়ে। এখানে দুটা বিষয়। প্রথমত আমাদের কর্মপরিকল্পনা এখনো ঠিক হয়নি। দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা ঠিক হলেও কিছুটা গোপনীয়তা রাখা হবে যাতে পরিকল্পনা ভেস্তে না যায়। নিজেদের স্বার্থে কাদের-চুন্নু ভাই দলকে বেঁচে দিয়েছেন। এভাবে মেরুদ-হীন লোকের সঙ্গে রাজনীতি করা যায় না। আমরা তাদের দলে রাখতে চাই কিন্তু শীর্ষ পদে দেখতে চাই না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জিএম কাদের এরশাদ সাহেবের ছোট ভাই। আর শেরীফা কাদের জিএম কাদেরের স্ত্রী, এ ছাড়া তাদের যোগ্যতা কী? তারা রাজনীতির র’টাও বোঝেন না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখবে। হ্যা ম্যাডামের সঙ্গে আমাদের মনোমালিন্য ছিল, আমরা দলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেটা ভুলে গিয়ে তাকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। ভোটের পর পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে আন্দোলন ও শীর্ষ নেতাদের পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেয়ার কারণে বহিষ্কার করা হয় শীর্ষ দুই নেতাকে।
দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ অবশ্য আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন দলীয় সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে। তার সঙ্গে বহিস্কার হন প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়। তিনি নির্বাচনের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
এ ছাড়া ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি সমন্বয় করছেন বলে জিএম কাদেরপন্থি নেতারা মনে করছেন। এই দুই নেতাকে বহিষ্কারের পর রাজধানীতে এক সভায় মিলিত হয়েছিলেন দলটির নেতাকর্মীদের একাংশ। তাদের মধ্যে পরাজিত অনেক প্রার্থী ছিলেন। ওই সভা থেকে তাদের নির্বাচন নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ওইদিনই ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টুকে দল থেকে বহিষ্কার করেন জিএম কাদের। সেন্টু সেদিনের সভায় জোরালো বক্তব্য রাখেন।
শফিকুল ইসলাম সেন্টু গতকাল বলেন, রওশন এরশাদ দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি মায়ের মতো কাজ করেছেন। তিনি আমার খোঁজ নিয়েছেন, আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। তাকে আমি ক্ষুব্ধ, হতাশ সকল নেতাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বহিষ্কার হবার পর তিনি আমার খোঁজ নিয়ে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। এমনটাইতো আমরা আশা করি অভিভাবকদের কাছ থেকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি আমাদের অভিভাবক। ভবিষ্যত নিয়ে কোনো আলোচনা এখনো হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি কিংবা আমাদের ক্ষুব্ধ নেতারা প্রয়োজনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |