আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ—এক সময় আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা তাদের প্রভাব এবং ক্ষমতার কথা সকলে জানত। আওয়ামী লীগের নেতা ছাপিয়ে তারা জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকও ছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত নেতারা আজ যেন ক্ষমতার কেন্দ্রের বাইরে। আওয়ামী লীগে তাদের অবস্থান অনেকটা অপাঙ্ক্তেয়। এবার নির্বাচনে যদিও তারা মনোনয়ন পেয়েছেন এবং জয়ী হয়েছেন কিন্তু তারপরও দলে তাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেই। এরা প্রত্যেকেই প্রবীণ, হয়তো এ বারের নির্বাচনই তাদের শেষ নির্বাচন। তাহলে কি তাদের রাজনৈতিক অধ্যায় শেষ হয়ে গেল?
আমির হোসেন আমুকে এক সময় মনে করা হত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের তিনি একজন ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আমির হোসেন আমু। কখনো দলের সাধারণ সম্পাদক হতে না পারলেও তিনি দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারকদের একজন ছিলেন নির্দ্বিধায়। আর এই আমির হোসেন আমু তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম নীতিনির্ধারক গণ্ডি থেকে ছিটকে পড়েন ওয়ান ইলেভেনের সময়। সেই সময় তিনি সংস্কারপন্থি হন এবং সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এরপর আওয়ামী লীগে তার অবস্থান অতটা সংহত হয়নি। প্রেসিডিয়াম সদস্য থেকে তিনি ছিটকে যানে উপদেষ্টামণ্ডলীর আলংকারিক সদস্যে। এরপরও ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু এটাই তার মন্ত্রী হিসেবে শেষ দায়িত্ব পালনের ঘটনা। ২০১৮ এবং সর্বশেষ সদ্য গঠিত মন্ত্রিসভায় তিনি জায়গা পাননি। যদিও তিনি ১৪ দলের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সেই ১৪ দলও এখন অস্তিত্বের সংকটে। এই অবস্থায় আমির হোসেন আমুর রাজনৈতিক পরিণতি কি হবে? তিনি না আছেন মন্ত্রিসভায়, না আছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী গণ্ডিতে। তাহলে কি আমির হোসেন আমুর মতো একজন বর্ষীয়ান গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের অধ্যায়ের সমাপ্তি করতে যাচ্ছে?
একই রকম কথা বলা যায় তোফায়েল আহমেদের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়ে ওঠা একদা ছাত্রলীগের এই তুখোড় নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। জাতির পিতা তাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় রাজনৈতিক সচিব করেছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর তার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। তিনি যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি—এরকম অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতির। এমনকী আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্প্রতি এক লেখায় তোফায়েল আহমেদকে ফোন করে বঙ্গবন্ধু পাননি—এই মন্তব্য করেছেন। এরকম বাস্তবতায় তোফায়েল আহমেদ পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতি করেছেন প্রতিকূলতার বিপক্ষে। কিন্তু তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায় এক-এগারোর সময়, যখন তিনি সংস্কারপন্থি হিসেবে আবির্ভূত হন। আমির হোসেন আমুর মতো তিনিও সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরও ২০১৪ সালে মন্ত্রিসভায় তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর এই সময়ে এটি ছিল তোফায়েল আহমেদের শেষ দায়িত্ব পালন। এরপর শারীরিকভাবে নানা অসুস্থতা এবং দলে তার অপাঙ্ক্তেয় অবস্থার কারণে এখন অনেকটাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এবারের মন্ত্রিসভাতেও তিনি জায়গা পাননি। দলে তার সরব উপস্থিতি আগের মতো আর লক্ষ্য করা যায় না।
তোফায়েল আহমেদের রাজনৈতিক অধ্যায়েরও সমাপ্তি দেখছেন অনেকে।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম এখনো অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। কিন্তু তিনি একমাত্র ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত দলের মন্ত্রিসভা একবারও জায়গা পাননি। তবে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসাবে তার অবস্থান আছে। কিন্তু সরকার গঠনে বা আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক মহলে তার কতটা সংহত অবস্থান তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আবুল হাসনাত আবদুল্লাহও এক সময় আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। নীতিনির্ধারকও ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সভাপতি স্বদেশে ফিরে যাদের ওপর নির্ভর করতেন তাদের মধ্যে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ছিলেন অন্যতম। কিন্তু রাজনীতি হলো চড়াই উতরাইয়ের এক নিষ্ঠুর চক্রাকার খেলা। এই খেলায় শেষ পর্যন্ত তিনি অনেক পিছিয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে তার পুত্র সাদিক আবদুল্লাহকে গত নির্বাচনে বরিশাল সিটি করপোরেশনে মেয়র হিসেবে মনোনয়ন না দেয়ার পর তার সাথে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। এই দূরত্বের রেশ এখনো কেটে বলে মনে হয় না। আমির হোসন আমু বা তোফায়েল আহমেদের মতোই কি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি দেখছে কেউ? এই সব বর্ষীয়ান নেতাদের স্থান কারা পূরণ করবে সেটিই আওয়ামী লীগের জন্য এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |