দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত রংপুরে আরও একটি আসন হারিয়েছে দলটি। ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে কেবল জাতীয় পার্টি পেয়েছে রংপুর-৩ (সদর ও সিটি করপোরেশন) আসন। এ আসনে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। দীর্ঘদিন ধরে দলটির দখলে থাকা রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও সিটি করপোরেশন) আসনটিতে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান বাবলু (ঈগল), অন্যদিকে এ আসনে জাপার প্রার্থী হয়েছে তৃতীয়। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসন হারানোসহ ৩টি আসনে দলের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দুর্গে করুণ পরিণতির পেছনে সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনকে দায়ী করেছে দলের প্রধান। আগামীতে দলকে আরও সুসংগঠিত করে রংপুরের উন্নয়ন ও আসন পুনরুদ্ধারে কাজ করার কথা জানিয়েছেন দলের নেতারা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রংপুর-১ আসনে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৩২টি ভোট পড়েছে। আওয়ামী লীগের ছাড় দেয়া এ আসনের ১২৩টি কেন্দ্রের ফলাফলে ৭৩ হাজার ৯২৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবলু (কেটলি)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মসিউর রহমান রাঙ্গা (ট্রাক) পেয়েছেন, ২৪ হাজার ৩৩২ ভোট। এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ ১০ হাজার ৮৯২ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।
গত ১৮ই ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর মসিউর রহমান রাঙ্গা ও আসাদুজ্জামান বাবলু রংপুর-১ আসনে গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় অতিক্রম করলেও হোসেন মকবুল শাহরিয়ারকে নির্বাচন নিয়ে তেমন তৎপর দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেয়া আসনে বিজয় সহজ ভেবেই আসিফ নির্বাচনে মাঠে কাজ করেননি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ভোটাররা।
রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে ১ লাখ ৭০ হাজার ৯৪৫টি ভোট পড়েছে। এখানে ১৩৬ কেন্দ্রের ফলাফলে ৮১ হাজার ৫৯৯ ভোট পেয়ে টানা তৃৃতীয়বার নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক (নৌকা)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু (ট্রাক) পেয়েছেন, ৬১ হাজার ৫৮৩ ভোট। এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনিছুল ইসলাম মণ্ডল ২৪ হাজার ৬৪০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। তবে তিনি জামানত হারাননি। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই নেতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেননি সাবেক সংসদ সদস্য আনিছুল ইসলাম মণ্ডল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করায় এলাকার মানুষের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ভোটের মাঠে বলছেন সচেতনতরা।
রংপুর-৩ (সদর ও সিটি করপোরেশন) আসনে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ ভোট পড়েছে। এতে ১৭৫টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফলে ৮১ হাজার ৮৬১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের (লাঙ্গল)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানী (ঈগল) পেয়েছেন ২৩ হাজার ৩২৬ ভোট। আওয়ামী লীগের ছাড়ের এ আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অনেকটা সহজ জয় হয়েছে জিএম কাদেরের।
রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) আসনে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩১৬টি ভোট পড়েছে। ১৬৩টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফলে ১ লাখ ২১ হাজার ৮৯৩ ভোট পেয়ে টানা চতুর্থবার নির্বাচিত হন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি (নৌকা)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মোস্তফা সেলিম বেঙ্গল (লাঙ্গল) পেয়েছেন ৪১ হাজার ৬৭১ ভোট। তিনি জামানত হারাননি। রংপুর-৪ আসনে টিপু মুনশির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেঙ্গল ছাড়া অন্য কেউ ছিলেন না। এ আসনে আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও প্রত্যাহারের শেষ দিনে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ ভোটে সহজ বিজয় হয় টিপু মুনশির।
রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে ২ লাখ ৩৩৭ ভোট পড়েছে। ১৫০টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফলে ১ লাখ ৯ হাজার ৭০৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী, মিঠাপুকুর উপজেলার সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন সরকার (ট্রাক)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী রাশেক রহমান (নৌকা) পেয়েছেন ৭৪ হাজার ৫৯০ ভোট। এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনিছুর রহমান ১০ হাজার ৩৩৪ ভোট পাওয়ায় তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার ভাই আনিছুর রহমান রংপুর-৫ আসনে প্রথমবারের মতো নির্বাচন করেছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগ দুই নেতার ভোটযুদ্ধে জামায়াত-বিএনপি’র ভোটকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল জাতীয় পার্টি। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় সফল হয়নি তারা।
রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪২৪ ভোট পড়েছে। এতে ১১১টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফলে ১ লাখ ৮ হাজার ৬৩৫ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী (নৌকা)। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (ট্রাক) পেয়েছেন ৩৬ হাজার ৮৩২ ভোট। এতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুর আলম ৯ হাজার ১৬ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও নুর আলম তেমন সুবিধা করতে পারেননি। পীরগঞ্জের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সকল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হওয়ায় এ আসনে জাতীয় পার্টি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে আছে। নির্বাচনে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর বিপক্ষ ভোটগুলো চলে গেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলামের ঘরে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, জাতীয় পার্টি রংপুরে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী থাকলেও নির্বাচনে প্রার্থীরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। সরকারি দলের প্রার্থীরা যেভাবে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, তা জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা পায়নি। ফলে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা এবং মানুষ নির্বাচন থেকে বিমুখ হওয়ায় লাঙ্গলে কম ভোট পড়েছে। আশা করছি আগামীতে আমরা দলকে আরও শক্তিশালী করে নির্বাচনে ভালো ফলাফল করতে পারবো।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, নির্বাচনের আগের দিন থেকে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টির প্রার্থী-এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে আসছিল। নির্বাচনের দিন তারা কেন্দ্র দখল করে আমাদের এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ নৌকার প্রতীকে সিল মেরেছে। ফলে আমাদের প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তারা নির্বাচনের ফলাফলে খারাপ করেছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অর্থ, পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন ও নিরপেক্ষ প্রশাসন রাখার আশ্বাস দিয়েও কথা রাখেনি।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |