প্রচ্ছদ আইন আদালত র‌্যাবের দায় পায়নি তদন্ত কমিটি

র‌্যাবের দায় পায়নি তদন্ত কমিটি

আইন-আদালত : র‌্যাবের হাতে শারীরিক নির্যাতনের ফলে নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার শাখার সচিবের নেতৃত্বে গঠিত ৮ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি ৩০২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন গত বছরের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে দাখিল করে।

এতে বলা হয়েছে, জেসমিনকে গত বছরের ২২ মার্চ আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ, ডিজিটাল তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও জব্দ তালিকা প্রস্তুত শেষে গাড়িতে করে রাজশাহী জেলার রাজপাড়া থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং গাড়িতে বমি করেন। তখন র্যাবের সদস্যরা নওগাঁ জজকোর্টের সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে তাকে দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সদর হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে এর সত্যতা পাওয়া যায়। জেসমিনকে হাসপাতালে ভর্তির পর র্যাবের পক্ষ থেকে তার আত্মীয়স্বজনকে বিষয়টি অবহিত করা হয়।

নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। এরপর রোগীর আত্মীয় ও র্যাব সদস্যরা ২২ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার সময় জেসমিনকে নিয়ে রামেক হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। রাত ৯টা ১০ মিনিটে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ২৪ মার্চ সকাল ৭টায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় এবং ওইদিন সকাল ১০টায় তিনি মারা যান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসক এবং নার্সদের বক্তব্য, রোগীর শারীরিক অবস্থা ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যালোচনা, সিটি স্ক্যান রিপোর্ট, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জেসমিনের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ব্রেইন টিস্যুতে রক্তক্ষরণের কারণে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার (Cardio-respiratory failure due to intracerebral haemorrhages) কথা বলা হয়। রোগীর মাথায় বাইরের দিক থেকে কোনো গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু কপালের বাঁপাশে একটি ইনজুরি ছিল, যা ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক দলের বক্তব্যমতে এটা মৃত্যুর কারণের জন্য যথেষ্ট নয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক দলের মতে, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া। র্যাব কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের ফলে জেসমিনের মৃত্যুর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুগ্ম পরিচালক এনামুল হকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ২০১৭ সালে হ্যাকড হয়। এই সুযোগ প্রতারক চক্র কখনো চাকরি দেওয়ার কথা বলে, কখনো কম খরচে হজে নেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকে। ভুক্তভোগী এসব ব্যক্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে এনামুল হক এসব প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জিডি করেন। পরে এনামুল হক জানতে পারেন, তার হ্যাকড ফেসবুক আইডি থেকে চাকরি দেওয়ার নামে সুলতানা জেসমিনের সোনালী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা প্রেরণের অনুরোধ জানানো হচ্ছে। দায়েরকৃত জিডি মূলে কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় এনামুল ঢাকার র্যাব সদর দপ্তর বরাবর প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেয়। এ ছাড়া আটকের পর ২৩ মার্চ বিকেলে জেসমিনসহ অজ্ঞাতপরিচয়ের দুই থেকে তিনজন আসামির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মাধ্যমে হ্যাকার গ্রুপের সঙ্গে জেসমিনের আদান-প্রদানকৃত তথ্য, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং দাখিলকৃত কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মহাদেবপুর শাখায় তার সোনালী ব্যাংকের হিসাবে গত বছরের ২ জানুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে ১৯ লাখ ১০ হাজার টাকা জমা হয় এবং ১৯ লাখ ৮ হাজার টাকা উত্তোলনপূর্বক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (নগদ ও বিকাশ) মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পাঠানো হয়। টাকাগুলো প্রকৃতপক্ষে কার কাছ থেকে, কী উদ্দেশ্যে পেয়েছে এবং কাদের কাছে পাঠানো হয়েছে সেটি রাজপাড়া থানায় দায়ের মামলায় তদন্তাধীন রয়েছে।

প্রতিবেদনে র্যাবের তদন্তের এখতিয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, দ্য আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন আইন-২০০৩ অনুযায়ী র্যাব কোনো অপরাধ বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ বা সরকার কর্তৃক নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো অপরাধের তদন্ত করতে পারে। তা ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পুলিশ বা র্যাবের রয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধি-১৮৯৮-এর ৬১ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করলে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জেসমিনকে রাজপাড়া থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়নি।

এ প্রতিবেদন গত ১৫ অক্টোবর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চে উত্থাপন করা হলে এতে হাইকোর্ট অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, ‘প্রতিবেদনটি অস্পষ্ট। প্রতিবেদনে জেসমিনকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তাকে গ্রেপ্তারের পর আত্মীয়স্বজনকে জানানো হয়েছিল কি না, তা উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে আদালত এ প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট নন। পরে এ বিষয়ে জারি করা রুল শুনানির জন্য প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে রুল শুনানির জন্য ওই বছরের ২৯ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। এরপর ওই আদালতের বিচারিক এখতিয়ার পরিবর্তন করা হয়।

জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবীর মনোজ কুমার ভৌমিক গতকাল বলেন, হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে আর মামলাটি কার্যতালিকায় আসেনি। এখন এখতিয়ার সম্পন্ন নতুন বেঞ্চে বিষয়টি শুনানির জন্য উত্থাপন করব। এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে তিনি কোনো তথ্য দিতে ও মন্তব্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।

জানা যায়, র্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যু-সংক্রান্ত প্রকাশিত খবর গত ২৭ মার্চ হাইকোর্টের নজরে নিয়ে স্বপ্রণোদিত আদেশ চেয়েছিলেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। পরে আদালতের নির্দেশে ২৮ মার্চ তিনি হাইকোর্টে এ বিষয়ে রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে গত ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট কোনো মামলা ছাড়াই জেসমিনকে র্যাবের হেফাজতে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া তা আইনগতভাবে কতটুকু সঠিক ছিল এবং র্যাবের কোনো এখতিয়ার ছিল কি না, তা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।

তদন্তকালে জেসমিনকে আটকের সঙ্গে র্যাবের যেসব সদস্য জড়িত ছিলেন তাদের দায়িত্ব পালন থেকে সরিয়ে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মামলা ছাড়াই জেসমিনকে তুলে নেওয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। ওই আদেশ অনুযায়ী গত বছরের ২২ মে ৮ সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।