দেশজুড়ে: গণপরিবহন মানেই যেখানে লক্কড়ঝক্কড় বাস, সেখানে এই খাত স্মার্ট ও উপযোগী করতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, এমন প্রশ্ন রাজধানীবাসীর।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসে ঢাকার রাস্তার গণপরিবহন নিয়ে বলেন, ঢাকার রাস্তার বাসগুলো দেখলে মনে হয় গরিব গরিব চেহারা। জীর্ণ মুড়ির টিন চলছে। গায়ে লেখা ‘আল্লাহর নামে চলিলাম’। এমন আনস্মার্ট যান কীভাবে চলে, এমন প্রশ্ন খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর।
এ প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। প্রতিদিন দেশে ১২-১৫ জন সড়কে মারা যাচ্ছে, যার বেশিরভাগ ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে।
মজুমদার আরও জানান, দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। এসব যানবাহনের মধ্যে ৩০ শতাংশ রাস্তায় চলাচল করে না। বাকি ৭০ শতাংশ দেশের পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তায় বড় সংকট তৈরি করছে। এসব যানবাহন জব্দ করে ডাম্পিংয়ে পাঠিয়েও কমানো যাচ্ছে না।
এদিকে ২০২০ সালে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ফিটনেসবিহীন কোনো গাড়ি সড়কে চলতে পারবে না। অথচ আদালতের নির্দেশের পরও সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি হরহামেশা চলছে, যেন দেখার কেউ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে চলাচলের জন্য যেকোনো বাহনের যান্ত্রিক ও কাঠামোগত ফিটনেস থাকতে হয়। কাঠামোগত দিকটি চোখে দেখা গেলেও, যান্ত্রিক দিক পুরোপুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করার মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত সক্ষমতা এই মুহূর্তে বিআরটিএর নেই। সংস্থাটির আন্তরিকতার অভাবের পাশাপাশি লোকবল সংকটও রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেয়া হয় বলেও অভিযোগ আছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৫৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৩৫ লাখের নিবন্ধন থাকলেও বাকি ১৫ লাখের কোনও সনদ নেই। আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন না থাকা গাড়িগুলোর ফিটনেস সনদও না থাকার কথা। তাছাড়া ফিটনেস সনদ হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নিয়মিত করছেন না বাস মালিকরা। বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জমা দেয়া এক জরিপ প্রতিবেদনে।
আদালতের নির্দেশে গঠিত একটি জাতীয় নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি সে সময় জানায়, ৮৩টি যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেস নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এর ফলাফলে দেখা যায়, ২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট সঠিক নেই অথবা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই ৩৩ শতাংশ বাসের, ৫৬ শতাংশের স্পিড গভর্নর সিল নেই।
বিআরটিএ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাব বলছে, দেশে নিবন্ধিত যে ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৬০টি যানবাহনের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্তত সাড়ে ৫ লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফিটনেস পরীক্ষা না করায় প্রক্রিয়াটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে বুয়েটের অধ্যাপক ও নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ এম এ খালেক বলেন, একটি আধুনিক শহরের পরিবহন ব্যবস্থা যদি উন্নত ও যুগোপযোগী না হয়, তাহলে কোনোভাবেই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে যদি উন্নত করা যায়, তাহলে যাত্রীরা সেই পরিবহন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আর একটি বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো, কোনোভাবেই যেন মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি রাজপথে চলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, যানবাহন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে একটি শহরের চরিত্র অনুধাবন করা যায়। যে শহর যত উন্নত তার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম ততো উন্নত। পরিকল্পিত যানবাহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো শহর উন্নত শহরের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে রাজধানী ঢাকা শহরের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। রাজধানীর জনসংখ্যা এখন প্রায় ২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, রাজধানী শহর ঢাকা যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, জনসংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে পরিবহন ব্যবস্থা আধুনিক এবং যুগোপযোগী হতে পারেনি।
জাইকার এক সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় দরকারি যাতায়াত বা কাজে যাওয়ার জন্য ৬০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে। এর ৬৭ শতাংশের বাহন বাস-মিনিবাস। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা ঠিক করতে হলে তাই প্রথম বাস ও মিনিবাস চলাচলের ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকার যানজটের সমস্যা নিরসনে নেয়া সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) বলা হয়েছে, বর্তমানে বাস যেমন যাত্রী চলাচলের প্রধানতম বাহন, ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে। এমনকি সাতটি এমআরটি-বিআরটি তৈরির পরও এগুলো সব মিলিয়ে ২০ শতাংশের বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না। এ কারণে আরএসটিপিতে বাসের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে এবং এ জন্য তিন থেকে পাঁচটি কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে ৪০টি করে ব্যক্তিগত গাড়ি নামছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার, যা ২০২৩ সালে হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় চলা বেশির ভাগ বাস-মিনিবাস রংচটা ও লক্করঝক্কর মার্কা। বাসগুলোয় দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করে যেতে হয়। প্রয়োজনের সময় বাস পাওয়া এবং সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। নারী, শিশু ও বয়স্কদের জন্য ঢাকার বাসে চলাচল তো এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ফলে কোনো ব্যক্তির যদি ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার মতো আর্থিক সামর্থ্য তৈরি হয়, তাহলে তিনি তার ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য তা কিনবেন না কেন? বাস্তবে ঘটছেও তাই।
আর ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে রাস্তায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। যানজট কমাতে গণপরিবহন ও মিনিবাস বাড়াতে হবে। এ জন্য দরকার অত্যাধুনিক ও ফিটনেস সম্পন্ন গাড়ি। তবেই ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হবে এবং যাত্রীরা স্বস্তি পাবেন বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |