প্রচ্ছদ দেশজুড়ে স্বামী চাচ্ছিলেন স্ত্রী বাঁচুক, স্ত্রী চাচ্ছিলেন স্বামী বাঁচুক

স্বামী চাচ্ছিলেন স্ত্রী বাঁচুক, স্ত্রী চাচ্ছিলেন স্বামী বাঁচুক

দেশজুড়ে: বিপদের সময় পরীক্ষার মুখোমুখি হয় মানুষের ভালোবাসা। সেই পরীক্ষায় কেউ উতরে যান আবার কেউ ব্যর্থ হন। তবে রাজধানীর বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনায় নিহত এক দম্পতি যেন মারা যাওয়ার আগে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দেখিয়ে গেলেন। হাসান ও সুমাইয়া দম্পতির পরস্পরকে বাঁচানোর আকুতিভরা গল্প আজকের পত্রিকাকে শুনিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রেড ক্রিসেন্টের কর্মী শেখ রাকিব। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে গ্রিন কোটি কটেজ নামের একটি বহুতল ভবনের নিচতলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে ভবনটির অন্যান্য তলায়। ব্যাপক ধোঁয়া ও প্রচণ্ড গরমে ভবনের ভেতরে আটকে পড়া মানুষের অবস্থা দিশেহারা। ধোঁয়াচ্ছন্ন ভবনে কেউ কাউকে দেখতেও পারছিল না। এমন অবস্থায়ও ভবনটিতে উদ্ধারকাজ চালিয়েছে রেড ক্রিসেন্টসহ বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

যাঁরা উদ্ধারকাজ চালিয়েছেন, তাঁদের একজন শেখ রাকিব। তিনি আটকে পড়া ১১ জনকে নিজ হাতে উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অবশ্য সাতজন রাতেই মারা গেছেন। রাকিব নিজেও এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। আটকে পড়াদের সবাই যখন নিজের জীবন বাঁচাতে সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছেন, তখন এই উদ্ধারকর্মী ভিন্নধর্মী এক ঘটনার সাক্ষী হন। আজকের পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে সেই ঘটনার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন রেড ক্রিসেন্টের এই স্বেচ্ছাসেবী। তিনি বলেন, ‘সময়টা ঠিক মনে নেই। ভবনের ভেতর থেকে এক নারী ও এক পুরুষকে উদ্ধার করে এনে আমার কাছে দেওয়া হলো। আমি মূলত অ্যাম্বুলেন্সে করে উদ্ধার করা রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছিলাম সে সময়।’

রাকিব বলেন, ‘এই দুজনকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য যখন অ্যাম্বুলেন্স ছাড়ল, তখন উভয়েই শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এ সময় করণীয় হলো, তাদের বুকে চাপ দিয়ে দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা। যেহেতু লোক দুজন আর আমি একা মানুষ, তাই দুজনকে একসঙ্গে প্রেস করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পুরুষ ব্যক্তির বুকে প্রেস করছিলাম, আবার তাঁকে বাদ দিয়ে নারীর বুকে প্রেস করছিলাম। অনেকক্ষণ আটকা থাকায় তাদের শ্বাসকষ্ট প্রকট ছিল।’ সময় যত গড়াচ্ছিল ওই দুজনের অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল উল্লেখ করে শেখ রাকিব বলেন, ‘এমন সংকটে পড়ে আমার অবস্থা দিশেহারা। যানজটের কারণে দ্রুত হাসপাতালেও পৌঁছাতে পারছিলাম না। রাস্তায় আটকে থেকে তাঁদের ছটফটানি দেখছিলাম। একপর্যায়ে দুজনের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকল। তখন পুরুষটি আমাকে বারবার বলছিলেন, নারীটির বুক ভালোভাবে যেন প্রেস করা হয়। আমি যখন নারীর বুকে প্রেস করতে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি অনুনয় করে বলছিলেন, তাঁকে বাদ দিয়ে পুরুষটিকে যেন ভালোভাবে বুকে প্রেস করা হয়। তাদের এই আচরণ আমাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। আমি কী করব, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। জীবনে অনেক ক্রাইসিস দেখেছি, এতটা দ্বিধায় কখনো পড়িনি।’

একপর্যায়ে যানজট ঠেলে যখন রাকিব সেই দুজনকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছান, তখনো তারা বেঁচে ছিলেন। পরে অবশ্য দুজনই মারা গেছেন। মারা যাওয়ার পরে এই উদ্ধারকর্মী জানতে পারেন, তাঁরা দুজন স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। রাকিব জানালেন, এই দম্পতির একজনের নাম হাসান ও অন্যজন সুমাইয়া। উদ্ধারকাজে থেকে নিজেও অসুস্থ হয়ে গেছেন রাকিব। তারও দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট। আজ শুক্রবার সকালে তাঁকে দুই ঘণ্টা অক্সিজেন থেরাপি দেওয়া হয়েছে। গলা ও বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে সেই দম্পতির অসহনীয় অবস্থার কথা ভাবছিলেন। নিজের অসুস্থতা ছাপিয়ে সেই দম্পতির একে অপরকে বাঁচানোর আকুতিই তাঁকে বেশি পীড়া দিচ্ছে। রাকিব জানালেন, অ্যাম্বুলেন্সের সেই ঘটনাগুলো তাঁর জীবনে হয়তো একটি ট্রমা হয়ে থাকবে।

হাসান-সুমাইয়া দম্পতির ঘটনা এই উদ্ধারকর্মীকে একটা উপলব্ধি দিয়েছে। বেশ আক্ষেপের সুরে রাকিব বলেন, ‘গতকালের ঘটনায় পুড়ে খুব কম মানুষ মারা গেছে। প্রাণ হারানো প্রায় সবাই শ্বাসকষ্টে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। এ ধরনের ক্রাইসিসে মূলত পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স দরকার হয়। এর ব্যবস্থা তেমন ছিল না।’ রাকিব আরও বলেন, ‘এমন দুর্ঘটনার পর উদ্ধার করা ব্যক্তিদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা হলো সিপিআর, অর্থাৎ বুকে চাপ দেওয়া। তবে এটার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষিত লোক হলে ভালো হয়। কিন্তু আমাদের এমন প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না বললেই চলে। আমার মতো আরও কয়েকজন সিপিআর দিতে পারা লোক থাকলে হয়তো নিহতের সংখ্যা কম হতো। হয়তো ওই দম্পতিকেও বাঁচানো যেত।’ রাকিবের পর্যবেক্ষণের সত্যতা মিলেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের বক্তব্যে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এ ঘটনায় প্রায় সবাই দমবন্ধ হয়ে ও শ্বাসনালি পুড়ে মারা গেছে। আহতদেরও সবারই শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত। তাই চিকিৎসাধীন কাউকেই শঙ্কামুক্ত বলা যায় না।’

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।