দেশজুড়ে: উচ্চ আদালতের ৩২ বিচারপতির বাসায় সরকারি কর্মচারীকে (এমএলএসএস) দিয়ে গৃহকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হয়েছে। এতে ১৯ বিচারপতির পরিবারের বিরুদ্ধে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের কথা উঠে এসেছে। এ ছাড়া ১৬ বিচারপতি ও সাতজনের পরিবারের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে, তাদের মুখের ভাষা অশালীন। এ বিষয়ে তিন সদস্যের জাজেস কমিটি গঠন করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে ১০২ বিচারপতি কর্মরত। একজন বিচারপতি প্রতি মাসে ৩২ হাজার টাকা গৃহস্থালি ভাতা পান। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিচারপতির আদালতের চেম্বারের জন্য একজন পিয়ন এবং বাসার কাজের জন্য একজন করে দারোয়ান ও বাবুর্চি দেওয়া হয়। তবে বেশ কয়েকজন বিচারপতি প্রভাব খাটিয়ে তাদের বাসায় দুই থেকে ছয়জন এমএলএসএস নিয়েছেন। এর মধ্যে চার অবসরপ্রাপ্তসহ হাইকোর্ট বিভাগের ৩২ বিচারপতির বাসায় ৭০ জন (১০ নারীসহ) এমএলএসএসকে কাজে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে দাপ্তরিক কাজের সহায়তার জন্য ৪৫৪ জন এমএলএসএস কর্মরত। তাদের বেশির ভাগই এসএসসি পাস। কেউ কেউ স্নাতকোত্তর কিংবা এমবিএ ডিগ্রিধারীও রয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০১৪ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এমএলএসএস পদের নতুন নাম অফিস সহায়ক। তাদের কাজ মূলত অফিসে সীমাবদ্ধ। ১৯৬৯ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, অফিস সহায়করা অফিসের আসবাব ও রেকর্ড সুন্দরভাবে বিন্যাস, ফাইল ও কাগজপত্র স্থানান্তর, হালকা আসবাব সরানো, ফাইল অন্য অফিসে নেওয়া, কর্মকর্তাদের পানীয়জল পরিবেশন, মনিহারি ও অন্যান্য জিনিস সংরক্ষণ, ইউনিফর্ম পরা, কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা, ভদ্র ব্যবহার করা, ব্যাংকে চেক জমা ও টাকা তোলা, ১৫ মিনিট আগে অফিসে আসা এবং বিনা অনুমতিতে অফিস ত্যাগ করবে না। কিন্তু আদালতের যেসব কর্মচারীকে বাসায় পাঠানো হয়, তাদের গৃহকর্মী, বাবুর্চি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সরকারি বন্ধের দিনও তাদের ছুটি দেওয়া হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে গত ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তিন সদস্যের জাজেস কমিটি গঠন করেন। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকার। কমিটি তিন থেকে পাঁচ দিন সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে একটি প্রতিবেদন প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রধান বিচারপতির বিবেচনায় রয়েছে।
সমকালের হাতে আসা নথিতে অভিযুক্ত ৩২ বিচারপতির নাম রয়েছে। তবে সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুযায়ী তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩২ বিচারপতির বাসায় কর্মরত এমএলএসএসরা কোনো না কোনো দুর্ব্যবহার কিংবা অমানবিক আচরণের শিকার। তাদের সাপ্তাহিকসহ অন্যান্য ছুটির প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করানো হয়। দেখানো হয় ভয়ভীতি। কর্মচারীদের দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কার, মাছ কাটা, কাপড় ধোয়ানো, গৃহস্থালির সব কাজ করানো হয়। তা ছাড়া হাত তোলা, অনাহারে রাখা, পকেটের টাকা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে বাধ্য করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী কর্মচারী জানান, কাকরাইলে এক বিচারপতির বাসভবনে ১১ বছর ধরে কাজ করেন। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের পরও ছোট দুটি সন্তান ও সংসারের কথা চিন্তা করে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। ওই নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আপিল বিভাগের এক বিচারপতির বাসায় গত বছর এক নারী কর্মচারীকে ধাক্কা মেরে ধারালো বঁটির ওপর ফেলে দেওয়া হয়। এতে তাঁর পেটের ডান পাশে ক্ষত হলে আটটি সেলাই দিতে হয়। তার পরও তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় বাসায় কাজ করতে হয়েছে।
সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারপতির স্ত্রী বাসায় থাকা নারী এমএলএসএসের হাতে-পায়ে গরম পানি ঢেলে দেন। তাঁকে চিকিৎসকের কাছে না পাঠিয়ে বাসায় রেখে সপরিবারে মার্কেটে চলে যান। পরে ওই নারীর স্বামী এসে তাঁকে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। ভুক্তভোগীরা জানান, এসব অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে জানানো হলেও কারও অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় না। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে এড়িয়ে থানা পুলিশে যেতে ভয় পান ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবসরপ্রাপ্ত চার বিচারপতির বাসায় এখনও ১০ জন এমএলএসএস রয়েছেন। তবে বর্তমান হাইকোর্টের চারজন বিচারপতি বাসায় কোনো কর্মচারী নেননি। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ পাওয়া নতুন ২২ অতিরিক্ত বিচারপতির বাসায় এখনও কোনো এমএলএসএস দেওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়নি। বিচারপতিদের বাসাবাড়ি থেকে কর্মচারী প্রত্যাহার করে অফিসে বদলির দাবি জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম আলম ভূঁইয়া।এমএলএসএসদের নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারপতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সমকালকে জানান, তাদের বাসাও একটি আদালত। সেখানে দেখাশোনার জন্য একজন লোক দেওয়া হয়। কিন্তু তারা (এমএলএসএস) বাসায় আসার পর নানাজনের পরিচয় দেয়। যেন তাদের ভারী কোনো কাজে ব্যবহার না করা হয়। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তাকে কোনো কাজের আদেশ যেন না করি। তা ছাড়া সন্ধ্যার আগে বাসায় যাওয়ার জন্য তারা ব্যস্ততা দেখায়। আবার অনুমতি ছাড়া ছুটি কাটায় এবং এসে বলে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. আজিজ আহমেদ ভূঞা সমকালকে বলেন, এসব অভিযোগ আমাদের কাছে আসা উচিত নয়। বিচারপতিরা সাধারণত আদালত ও বাসার বাইরে যেতে পারেন না। তাদের দৈনন্দিন কাজ কে করবে? এটি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুপ্রিম কোর্ট বারের সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব সমকালকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে দুঃখজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিচারপতিদের বাসভবনের এমন ঘটনায় আমরা লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদী আচরণের এটি একটি উপসর্গ। আমার প্রত্যাশা, প্রধান বিচারপতি অনতিবিলম্বে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেবেন এবং ত্বরিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবেন।’ নাম না প্রকাশ করার শর্তে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক রেজিস্ট্রার সমকালকে বলেন, ‘মূলত এমএলএসএসদের বিচারকের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ কারণে কর্মচারীরা সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষিপ্ত। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। বিচারকদের দাবির মুখে একরকম জোর করে তাদের বাসায় কর্মচারী পাঠানো হয়।’ সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র (স্পেশাল অফিসার) মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন সমকালকে বলেন, এমএলএসএসদের বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। কমিটি অভিযোগ পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দাখিল করলে জানা যাবে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে কোনো আইনকানুন বা বিধান নেই। এটি কাস্টম (প্রথা)। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির বাসায় কাজের জন্য দু’জন, আপিল বিভাগের বিচারপতির বাসায় দু’জন করে কর্মচারী দেওয়া হয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের অভিযোগ কতটা সঠিক, না জেনে বলতে পারব না।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |