সারাদেশ: জাতীয় নির্বাচনসহ আগামী জুন পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচন আয়োজনের জন্য অতিরিক্ত আড়াই হাজার কোটি টাকা চেয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ আছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। শুধু জাতীয় নির্বাচনেই ব্যয় হবে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। এরপর আছে উপজেলা নির্বাচন। সব মিলিয়ে এখন ৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ চাইছে ইসি। কমিশনের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অতিরিক্ত প্রায় ২ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আধাসরকারি পত্র (ডিও) পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, বাজেট বরাদ্দের প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ ও ব্যয়ের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক কোড রয়েছে। নির্বাচন আয়োজনের জন্য মোট ২০টি খাতে অর্থ ব্যয় করে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে ১৭টি খাতের ব্যয় দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ইসির পত্র অনুযায়ী, ৩০০ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে ২ হাজার ২৭৬ কোটি ২২ লাখ ৩২ হাজার ১৩৯ টাকা ব্যয় হবে। দেশে কোনো একটি সংসদ নির্বাচন আয়োজনে ব্যয়ের দিক থেকে এটি নতুন রেকর্ড। এবারের ভোটে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রায় ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যক্রমে বাকি ১ হাজার ৫০ কোটি ৬০ লাখ ৩৮ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। তবে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে বাড়তি ব্যয় চলতি অর্থবছরের বাজেটের চূড়ান্ত সংশোধনীতে সমন্বয় করা হবে।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচন পরিচালনায় সম্ভাব্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৯২ কোটি ৩৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এর বিপরীতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি ৪৯ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা। ফলে বর্তমান বরাদ্দ থেকে অবশিষ্ট আছে ১ হাজার ৩৮২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, যা জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রয়োজনীয় অর্থের চেয়েও কম। এ অবস্থায় আগামী জুন পর্যন্ত সব নির্বাচন আয়োজনে কমিশন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সংশোধিত বাজেটে ২ হাজার ৪৩৭ কোটি ৮৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামী ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সারা দেশে একযোগে এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন প্রাথমিকভাবে প্রতি আসনে ৭ কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার ৫৪ টাকা খরচ নির্ধারণ করেছে। এ হিসাবে সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩০০ আসনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে মোট ব্যয়ের চাহিদা দিয়েছে মোট ২ হাজার ২৭৬ কোটি ২২ লাখ ৩২ হাজার ১৩৯ টাকা।
জাতীয় নির্বাচনের পরপরই সারা দেশে উপজেলা নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি উপজেলায় নির্বাচনী ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ১০ লাখ ৮০ হাজার ১৯০ টাকা। এ হিসাবে ৫২০টি উপজেলায় নির্বাচন সম্পন্ন করতে মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৬১৬ কোটি ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬১ টাকা। বাকি অর্থ ব্যয় হবে বিভিন্ন স্তরের উপনির্বাচনের জন্য।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, যদিও পুরো অর্থবছরের জন্য কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বরাদ্দ এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যে কোনো সময় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে উত্তোলন ও ব্যয় করতে পারবে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন যে কোনো দেশের জন্য অন্যতম মৌলিক ইস্যু। এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের কাজ। তবে কমিশনের এ কাজে প্রয়োজনীয় ব্যয়ের অর্থের জোগান নিশ্চিত করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। দেশীয় বাস্তবতায় পুরো অর্থ একসঙ্গে ছাড় করা সম্ভব হবে না। কিন্তু এতে কমিশনের প্রয়োজন মেটাতে কোনো ঘাটতিও হবে না। বিশেষ করে আপাতত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে যে অর্থ দরকার হবে, তার সবটাই অর্থ মন্ত্রণালয় জোগান দিতে প্রস্তুত, যা ছাড়ের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক কোড অনুযায়ী ধাপে ধাপে শুরু হয়েছে।
গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে তখন খরচ হয় ৪৫০ কোটি ও বাকি ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা কাজে। নির্বাচন আয়োজনে বাড়তি ব্যয় প্রসঙ্গে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘সময়ের বাস্তবতার কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে সংশোধিত বাজেটে কিছুটা বাড়তি চাহিদা থাকবে, এটা স্বাভাবিক। তবে যে ব্যয়ের প্রস্তাব শোনা যায়, তা আরও সংযত রাখা যেত বলেই আমার মনে হয়। এরপরও যে বিপুল ব্যয়ে এই নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে, তাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সেখানে অধিকসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি থাকতে হবে। একই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ভালো নির্বাচন হলে এবং পরে দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি তার সুফল পাবে।’
যে কারণে বেড়েছে সংসদ নির্বাচনের ব্যয়:
নির্বাচন পরিচালনা কাজে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা ছাড়াও মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন স্তরে সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরও সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। যাদের দায়িত্ব পালনে সম্মানী, যাতায়াতে পরিবহন ও জ্বালানি সুবিধা, খোরাকি ভাতা আগের তুলনায় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়েছে।
খোরাকি ভাতা ৩ গুণ:
নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে খোরাকি ভাতা পান বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সহায়ক ও পেশকাররা। এবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচনী মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদেরও আগের চেয়ে বেশিদিন রাখা হবে। ভোটকেন্দ্র বাড়ায় তাদের বেশিসংখ্যক সদস্যও মোতায়েন করতে হবে। এজন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে যে বরাদ্দ ছিল ১৫০ কোটি লাখ ১১ লাখ ১৮ হাজার টাকা, সংশোধিত বাজেটে এটি তিন গুণ বাড়িয়ে ৬৪৭ কোটি ৯১ লাখ ২২ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। অর্থাৎ ৪৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে কমিশন।
ক্ষতিপূরণ ভাতা:
প্রথমে এটি ৩ কোটি ৪৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা রাখলেও সংশোধিত বাজেটে ৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি ও যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিবেচনায় এই খাতে ক্ষতিপূরণের অর্থ বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
অধিককাল ভাতা:
সংশোধিত বাজেটে এটি প্রায় দ্বিগুণ করে ১০ কোটি ৮২ লাখ ২৩ হাজার টাকার জায়গায় ২০ কোটি ৮২ লাখ ২৩ হাজার টাকায় উন্নীত করেছ। কমিশন বলেছে, সরকারি মুদ্রালয়ে ব্যালট পেপার, নির্বাচনী বিভিন্ন ধরনের ফরম, প্যাকেট, ম্যানুয়াল, নির্দেশিকা, সীমানা ম্যাপসহ অন্যান্য কাজে এই ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
আপ্যায়ন ব্যয়:
নির্বাচনী কাজে আপ্যায়ন ব্যয় আড়াই গুণ বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে বাজেটে এ খাতে ব্যয় ধরা হয় ১৫২ কোটি ২৩ লাখ ৭১ হাজার টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি ৩৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৬৩ হাজার টাকা করা হয়।
যানবাহন ব্যবহার:
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর কাজে যানবাহনের খরচও বেড়েছে। এ ছাড়া পার্বত্য ও দুর্গম এলাকায় বিজিবি একই সঙ্গে হেলিকপ্টারও ব্যবহার করবে। এ কারণে এবার সংশোধিত বাজেটে এই ব্যয় আগের তুলনায় কয়েক গুণ বাড়িয়ে ৩০ কোটি ৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা থেকে একলাফে ২২৯ কোটি ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা করা হয়েছে।
প্রচার ও বিজ্ঞাপন ব্যয়:
জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে ভোটারদের অবহিতকরণসহ কমিশনের উদ্দেশ্য পূরণে যে প্রচার হবে এবং এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন বাবদ মোট খরচ আগের তুলনায় ব্যয় ৭ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৪ গুণ বৃদ্ধি:
মূল বাজেটে অনুমোদিত বরাদ্দ ছিল ৪৮ কোটি ৬২ লাখ ২৩ হাজার টাকা। সংশোধিত বাজেটে সেটি ২৩৯ কোটি ২৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এখানে ভোটকেন্দ্র প্রস্তুতকরণ কাজে কেন্দ্রের পরিবর্তে কক্ষপ্রতি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।
এ ছাড়া পেট্রোল অয়েল ও লুব্রিকেন্টে ২১৭ কোটি ২২ লাখ টাকা, মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ে ১১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা, মনিহারিতে ৩১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, সম্মানী ভাতায় ১১৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, শ্রমিক মজুরি ২৫ কোটি ৮ লাখ টাকা, ভেন্যু ভাড়া ১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা, পরিবহন ব্যয় ৮৫ কোটি ১২ লাখ টাকা, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদিতে প্রায় ১০ কোটি টাকা, স্ট্যাম্প ও সিলে ২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |