প্রচ্ছদ হেড লাইন মা-বাবার সঙ্গে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু আহাদের চোখে লাগে গুলি

মা-বাবার সঙ্গে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু আহাদের চোখে লাগে গুলি

হেড লাইন: গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেল ৪টা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলছিল। ওই সময় বাসার আট তলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মা ও বাবাকে দুই পাশে রেখে মাঝে দাঁড়িয়ে সেই সংঘর্ষ দেখছিল চার বছরের শিশু আহাদ। একপর্যায়ে একটি গুলি এসে তার ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার ভেতর আটকে যায়। মুহূর্তেই রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে আহাদ। পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়।

জানা গেছে, যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় একটি ১১ তলা ভবনের ভাড়া বাসার আট তলায় বসবাস করেন আয়কর বিভাগের উচ্চমান সহকারী আবুল হাসান (৩৫)। তিনি দুই ছেলে দিহান মাতুব্বর (১১) ও আব্দুল আহাদ (৪) এবং স্ত্রী সুমি আক্তারকে (২৯) নিয়ে সেখানে থাকেন। দিহান যাত্রাবাড়ীর একটি মাদরাসায় লেখাপড়া করে। আবুল হাসান ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের পুখুরিয়া গ্রামের মৃত বজলুর রহমানের ছেলে। বজলুর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আবুল হাসান ছোট।

আবুল হাসানের ভাই ও রাজৈর উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোকলেসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আহাদ আহত হওয়ার পর ঢাকার রাস্তার পরিস্থিতি একটা যুদ্ধাবস্থার মতো ছিল। অবস্থা এমন যে আহাদকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রিকশায় এগুনোর উপায় ছিল না। সারা রাস্তা ইটের টুকরায় ভরে ছিল। এর মধ্যে একটু এগুতেই একটি সিএনজি পাওয়া যায়। তাতে করে আহাদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর আহাদকে আইসিইউ ওয়ার্ডে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। তিনি বলেন, কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আমাদের বলেন- আহাদের মাথায় গুলি আটকে আছে। কিন্তু কোন অবস্থানে আছে তা বোঝার জন্য সিটি স্ক্যান করতে হবে। কিন্তু সিটি স্ক্যান করতে নেওয়া হলে আইসিইউ যন্ত্রপাতি খুলে ফেলতে হবে। এতে ওর মৃত্যুও হতে পারে। তবে সিটি স্ক্যান করাও জরুরি।

মোকলেসুর রহমান বলেন, শনিবার (২০ জুলাই) হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ও চক্ষু বিভাগের প্রধান আহাদকে দেখেন। তারা বলেন, আগে শিশুটির জীবন বাঁচানো দরকার। এ অবস্থায় সিটি স্ক্যান করার চিন্তা আমরা বাদ দেই। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আহাদকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সাথে সাথে আইসিইউয়ের ভেতরে যাই। তখন আহাদের নাক, মুখ ও বুকের যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলা হয়। তখনও আহাদের বুকে স্পন্দন হচ্ছিল। এ কথা কর্তব্যরত চিকিৎসককে বললে তিনি জানান, এ অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য বুকে স্পন্দন থাকে। যেহেতু লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তখন ইসিজি করে দেখা যায় একটি সরল রেখা এসেছে। তখন আমরা নিশ্চিত হই আহাদকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার আর কোনো আশা নেই।

তিনি বলেন, পারিবারের সদস্যরা বিনা ময়নাতদন্তে আহাদের মরদেহ নেওয়ার ইচ্ছে জানালে ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তাতে সায় দেয়নি। বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সুপারিশ করেও কোনো ফল হয়নি। পরে আহাদকে মর্গে নিয়ে রাখা হয় ওই রাতে। পরদিন রোববার (২১ জুলাই) শাহবাগ থানা থেকে এক এসআই আসেন বেলা ১১টার দিকে। মর্গে অনেক লাশ। তাই ময়নাতদন্তে অনেক ভিড় থাকায় আহাদের ময়নাতদন্ত শেষ করে মরদেহটি বুঝে পাই বিকেল ৩টার দিকে। এরপর দুটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আমরা ভাঙ্গার পুখরিয়া গ্রামে চলে আসি। পুখরিয়া রেলস্টেশন মসজিদে জানাজা শেষে বাদ মাগরিব বাড়ির উত্তর পাশে পারিবারিক কবরস্থানে আহাদকে দাফন করা হয়। বাড়িতে আগে পারিবারিক কবরস্থান ছিল না। আহাদকে দাফনের মধ্যে দিয়েই তার সূচনা হল। এদিকে নিহত আহাদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। আহাদের মা গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে আসেননি। বাড়িতে এক শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। বেঁচে আছেন আহাদের দাদি ওয়াহিদা বেগম (৮০)। তিনিও কোনো কথা বলেননি।

সরেজমিনে দেখা যায়, শিশু আহাদের মৃত্যুতে সারা পুখুরিয়া গ্রামে শোকের আবহ বিরাজ করছে। এ মৃত্যু যেন কেউ মেনে নিতি পারছেন না। আহাদের জানাজায় ওই গ্রামের অন্তত সহস্রাধিক লোকের সমাগম ঘটে। চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ এলাকার কেউ যেন বাদ যাননি। পুখুরিয়া রেলস্টেশনের ওপর কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ কৃষক শেখ সিদ্দিকের (৬৮) সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা এ ঘটনার জন্য আল্লার কাছে নালিশ দেই। এর থেকে বেশি কিছু বলার নাই। এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারব না। আমরা কাকে মারছি, ছাওয়ালকে মারছি, ভাইকে মারছি ,ভাতিজাদের মারছি এ যেন নিজেরাই নিজেদের বুকে গুলি চালাচ্ছি। কথা বলার জন্য আহাদের বাবা আবুল হোসেনের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি তার নিহত শিশুপুত্রের জন্য দোয়া চান। এছাড়া তিনি আর কিছু বলেননি।