গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তখন থেকে ভারতেই আছেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ বাংলাদেশের একাধিক আদালতে শতাধিক হত্যা মামলা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। বন্দি বিনিময় চুক্তিতে বাংলাদেশ হাসিনাকে ফেরত চাইবে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। হাসিনাকে দেশে ফেরানো নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থায়ও (ইন্টারপোল) আবেদন করেছে বাংলাদেশ। আবার ভারতের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, শেখ হাসিনাকে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করা ভারতের ঠিক হবে না।
বাংলাদেশের আবেদনে সাড়া দিয়ে ইন্টারপোল যদি রেড নোটিশ জারি করে, তবে কী হবে শেখ হাসিনার? তিনি কি ভারতে আর অবস্থান করতে পারবেন? নাকি ভারত তাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হবে?
রেড নোটিশ হলো কোনো একটি দেশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ, যা বিশ্বব্যাপী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে অস্থায়ীভাবে গ্রেপ্তারের জন্য জারি করা হয়। এটি প্রত্যর্পণ, আত্মসমর্পণ বা অনুরূপ আইনি কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে জারি করা হয়। এই নোটিশটি একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা আদালতের আদেশের ভিত্তিতে জারি করা হয়, যা অনুরোধকারী দেশের বিচারিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা ইস্যু করা হয়। প্রতিটি সদস্য দেশ তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী এই নোটিশ কার্যকর করে।
সাধারণত খুন, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন বা সশস্ত্র ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধের জন্য ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে থাকে। নোটিশে অপরাধীদের সম্পর্কে সমস্ত সদস্য দেশের পুলিশকে সতর্ক করে। এটি অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি আনতে সহায়তা করে, এমনকি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বহু বছর পরও এই রেড নোটিশ জারি করতে পারে ইন্টারপোল। যেহেতু ইন্টারপোলের শর্তে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার অভিযোগ স্পষ্ট, তাই ভারত তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি এড়াতে পারে না।
তবে রেড নোটিশের অধীনে ইন্টারপোল সরাসরি কোনো দেশে গিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করে না। তারা কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চেয়ে থাকে। ইন্টারপোল কোনো দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বাধ্য করতে পারে না যে, তারা এই নোটিশের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করবে। তবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সাধারণত ইন্টারপোলের নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধা রাখে। সে ক্ষেত্রে ইন্টারপোলের সক্রিয় রাষ্ট্র হিসেবে ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে পারে।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসেন ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসিমউদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে এসে বিদেশবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সামনে মুখোমুখি হন। বিক্রম মিশ্রি এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ভারত চাই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা ভারতে থেকে যে বিবৃতি দিচ্ছেন, তা ভারত সরকার সমর্থন করে না। এটি দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে একটি প্রতিবন্ধক। ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক একক রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে নয়। এ ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের জনগণকে গুরুত্ব দেয়।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক মন্তব্যের জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন। ভারত সরকার তাকে কোনো প্ল্যাটফর্ম বা সুযোগ দেয়নি, যা দিয়ে তিনি ভারতীয় ভূখণ্ডে বসে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন। এটি তৃতীয় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ না করার ঐতিহ্যগত রীতির অংশ।
বিক্রিম মিশ্রির ওই বক্তব্যের পর শেখ হাসিনাকে আর বাংলাদেশ বিরোধী কোনো বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।
বিক্রিম মিশ্রির সংবাদ সম্মেলনের পর বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করি, যথাসময়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে।’
এই নিয়ে আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, ‘ভারতের বিদেশ সচিব যখন বাংলাদেশে এসেছেন, তখন তাঁকে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এটা বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা একজন গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট। তাঁর এই মুহূর্তে বিচার হওয়ার কথা, তাঁর এখন জেলে থাকার কথা। কিন্তু তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই তিনি বিভিন্ন কর্মসূচি, বিভিন্ন বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আশা করি, এ ধরনের আর কোনো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারে ভারত তাঁকে বাধা দেবে।’
ভারতের সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে মনে করেন শেখ হাসিনার জন্য ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে না।
এ বিষয়ে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ভারতের কংগ্রেস নেতা ও সংসদ সদস্য শশী থারুর বলেন, ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। বাংলাদেশও। বাংলাদেশের জনগণের এই অধিকার থাকা উচিত যে তাদের ভবিষ্যৎ তারাই নির্ধারণ করবেন। এ জন্য আমাদের উচিত তাদের পাশে থাকা।
বাংলাদেশের পালাবদল নিয়ে কেরালার কংগ্রেস–দলীয় সংসদ সদস্য শশী থারুর বলেন, অবস্থা কী, তা সবারই জানা। কয়েক দিন ধরে পরিস্থিতি টালমাটাল।
তিনি বলেন, এটা ঠিক, যেখানেই এমন ধরনের জনপ্রিয় বিপ্লব হয়, সেখানে দুই–তিন দিনের মধ্যে সব স্বাভাবিক বা সবকিছুর সমাধান হয়ে যায় না। তবু আমরা চাই শান্তি বা সমাধান দ্রুত হোক। তারপর আমরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও আমাদের বন্ধন নিয়ে চর্চা করব।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে শশী বলেন, তাকে আমি অনেক দিন ধরেই জানি। নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। গোটা পৃথিবী তাকে সম্মান করে। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। আমার তো মনে হয়, তিনি বাংলাদেশকে স্থিতিশীল করে তোলার যোগ্য।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মন্দির ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা প্রসঙ্গে কংগ্রেসের এই নেতা বলেন, এ ধরনের দুই-একটা দুর্ঘটনা যে ঘটছে না, তা নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও দেখতে হবে, দাঙ্গার মধ্যেই বাংলাদেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দির রক্ষা করছেন। এমন খবর আমরা পড়ছি।
গত ১৭ অক্টোবর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মামলায় পৃথক মামলায় শেখ হাসিনা,ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |