মাহমুদুর রহমান দেশে ফিরলেন। আমার দেশ আবারও প্রকাশ করার ঘোষণা দিলেন। তারপর নানা মহল থেকে নানা সমালোচনার জন্ম নিতে দেখলাম। এর মধ্যে একটা গুরুতর সমালোচনা হচ্ছে, মাহমুদুর রহমান ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বৈধতা উৎপাদন করেছেন। যুক্তি হিসেবে তারা বলে যে, কিছু ব্লগারের ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ রচনা আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে ব্লগার হত্যার পটভূমি তৈরি করা হয়েছে এবং শাহবাগকে নাস্তিক-আস্তিক বিতর্কে বিভাজিত করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই শাহবাগের মূল স্পিরিট ছিল না। যেই ব্লগ একটা ক্ষুদ্র সার্কেলে পঠিত ছিল, সেটা ব্যাপক মানুষের কাছে তুলে ধরার মাধ্যমে আমার দেশ এই নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উৎপাদন করে তাদের ধারাবাহিক হত্যার পটভূমি তৈরি করে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমার দেশ কি প্রথম ধর্মবিদ্বেষী ব্লগ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা শুরু করে? উত্তর হচ্ছে ‘না’। ধর্মবিদ্বেষী ব্লগ নিয়ে প্রথম আলাপ শুরু হাইকোর্টে একটা রিটের মাধ্যমে। রিটটা হয় ২৬ জানুয়ারি ২০১২ সালে। শাহবাগীদের আন্দোলন শুরু হওয়ার এক বছরের বেশি আগে। মামলাটি স্টেইট ভার্সেস বাটুল সারোয়ার নামে পরিচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক বাটুল সরওয়ার ও ঢাকা সেন্টার ফর ল’ অ্যান্ড ইকোনমিকসের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম যে রিট আবেদনটি করেন, তাতে তাদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুহাম্মদ নওশাদ বলেছিলেন, ফেসবুকের পাঁচটি গ্রুপের পেজ এবং আরেকটি আলাদা ওয়েবসাইটে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কার্টুন ও অন্যান্য উপকরণ রয়েছে, যা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে।
এসব ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইটে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ ও ইসলামসহ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের যিশুখ্রিষ্ট, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গৌতমবুদ্ধ, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দেব-দেবী সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছে।
তবে, ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা প্রকাশ করতে তিনি রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না, ওই ওয়েব ঠিকানাগুলোয় গিয়ে কেউ মন্তব্যগুলো দেখুক।’
বাটুল সারোয়ার তার রিটে বলেন, এই ব্লগ ও ফেসবুক প্রোফাইলগুলো থেকে ধর্ম অবমাননা করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।
আদালত এই রিটের বিষয়বস্তু আমলে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
আদালতের আদেশ পাওয়ার পর হাসিনার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসলামিক স্কলারদের আমন্ত্রণ জানায় ধর্ম অবমাননার তথ্যপ্রমাণ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করার জন্য। কয়েক দফা বৈঠকের পর সুনির্দিষ্ট তালিকা যাচাই-বাছাই করে আপত্তিকর ব্লগ ও ফেসবুক পেজ চিহ্নিত করা হয়। ২০১২ সালের ২১ মার্চ এই তালিকা ধরে তাদের ইসলামবিদ্বেষী কার্যকলাপ বন্ধের জন্য হাইকোর্ট রুল জারি করে।
হাইকোর্টের রুলের পর ব্লগগুলো বন্ধ করার জন্য সরকার থেকে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেয়। সরকারি নির্দেশ পাওয়ার পর বিটিআরসি সেগুলো বন্ধ করে দেয়।
সেই সময় হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮৪টি ব্লগারের প্রোফাইল, ফেবু পেজ ও ওয়েবসাইটকে চিহ্নিত করেছিল। এরপর সেই ব্লগগুলো কারা চালায়, তাদের নামধাম, ছবি-ঠিকানা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংগ্রহ করে।
আপনাদের অনেকের মনে থাকতে পারে ‘ধর্মকারী’ নামে নাস্তিকদের মধ্যে জনপ্রিয় একটা সাইট এ সময়েই বন্ধ হয়। আলেম সমাজ এই ফয়সালা মেনে নেয়।
এই সাইটগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এ ইস্যুটা যখন ফয়সালা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তখন আবার নতুন করে আওয়ামী ওলামা লীগ সরকারের কাছে নাস্তিকদের একটা তালিকা দেয়। এই তালিকায় যাদের নাম ছিল, তাদেরই আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিহ্নিত করেছিল। এই তালিকার অনেকেই পরে আক্রান্ত ও নিহত হন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই তালিকা ওলামা লীগের কাছে কীভাবে গেল?
এ যাচাই-বাছাইয়ের সময় যেসব সাইট এবং ফেবু প্রোফাইলের নাম ধর্ম অবমাননাকারী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় এবং ওলামা লীগ যেই তালিকা দেয়, তাদের কয়েকজন পরে চাপাতি আক্রমণের শিকার হয়ে দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
মাহমুদুর রহমান সম্পাদিত আমার দেশ পত্রিকা থাবা বাবার ব্লগ প্রকাশের আগেই নাস্তিকদের তালিকা তৈরির ঘটনা ঘটেছে। আর থাবা বাবার ব্লগ আমার দেশ পত্রিকা প্রথমেই ছাপেনি। আগে ছেপেছে ইনকিলাব আর হাসিনা সরকারের মন্ত্রীর পত্রিকা ইত্তেফাক। আমার দেশ ছেপেছে পরে। আর আমার দেশে এটা ছাপা হয়েছে থাবা বাবার মৃত্যুর পরে, আগে নয়।
তাহলে মাহমুদুর রহমানের বিষয়ে আলাপের আগে তো বাটুল সারোয়ারের রিট, তার রায়, আদালতের নির্দেশনা ও সরকারের পদক্ষেপ, ওলামা লীগের তালিকা নিয়ে আলাপ করতে হয়। ধর্মবিদ্বেষী ব্লগ পত্রিকায় প্রকাশের আলাপও যদি করতে হয়, তাহলে আমার দেশের আগে ইনকিলাব আর ইত্তেফাকে ব্লগ প্রকাশের আলাপ করতে হবে। ইত্তেফাক আর ইনকিলাবের সার্কুলেশন আর পাঠকের সংখ্যা তো কম না। এই তালিকা তৈরির কাজটা তো করেছে সে সময়কার সরকারের আদালত আর প্রশাসন, যে তালিকা ওলামা লীগ প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এই ব্লগ প্রকাশে সংক্ষুব্ধ হন, কোনো মাদ্রাসাশিক্ষক বা ছাত্র রিট করেননি। এমনকি কোনো ইসলামপন্থিও রিট করেননি।
তাহলে কেন ব্লগার হত্যার পটভূমি তৈরির জন্য মাহমুদুর রহমানকে বলির পাঁঠা বানিয়ে সেক্যুলাররা ক্রুশে বিদ্ধ করেছে যিশুর মতো? এর কারণ কী এই যে, তিনি যেন তাদের সব আদিপাপকে ধারণ করে ক্রুশে ঝুলে থাকেন। আর নিষ্পাপ শাহবাগী সেক্যুলাররা তাদের পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরুত্থিত হয়।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |