
দেশে কিডনি রোগের প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে দেখা যায় যে অল্প বয়সের ছেলে মেয়েদের কিডনির সমস্যা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে ১৫-২৫ বছরের তরুনরা, বাইরে থেকে উত্তেজনামূলক ঔষধ খাওয়া, মোটা হওয়ার জন্য ঔষধ খাওয়া সহ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ঔষধ খাওয়ায় কিডনির সমস্যা শুরু হয়।
সেই সাথে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। অথচ প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে এবং সময়মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে এ রোগ এড়ানো সম্ভব।
কিডনি রোগের লক্ষণ:
কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো গুরুতর উপসর্গ না দেখালেও সময়মতো শনাক্ত না করলে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
১. মূত্রের পরিবর্তন:
*মূত্রের পরিমাণ কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া।
*মূত্রে রক্তের উপস্থিতি বা ফেনা হওয়া।
*ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা, বিশেষ করে রাতে।
২. শরীরের অস্বাভাবিক ফোলাভাব:
*মুখমণ্ডল, পা, গোড়ালি বা পুরো শরীরে ফোলাভাব।
*শরীরের জলীয় ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে এই লক্ষণ দেখা দেয়।
৩. চাপ ও ক্লান্তি:
*সবসময় ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা।
*কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে রক্তে টক্সিন জমে ক্লান্তি বাড়ায়।
৪. ত্বকের সমস্যা:
*তীব্র চুলকানি বা ত্বকের শুষ্কতা।
*শরীরে অতিরিক্ত ফসফরাস জমার কারণে এ সমস্যা হতে পারে।
৫. বমি বমি ভাব ও ক্ষুধামন্দা:
*খাদ্য গ্রহণে অরুচি এবং কখনো কখনো বমি হওয়ার প্রবণতা।
*শরীরে টক্সিন জমে এসব উপসর্গ দেখা দেয়।
৬. শ্বাসকষ্ট:
*কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে শরীরে তরল জমে ফুসফুসে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
*অ্যানিমিয়ার কারণে অক্সিজেনের ঘাটতিও শ্বাসকষ্ট বাড়ায়।
৭. উচ্চ রক্তচাপ:
*কিডনি সঠিকভাবে রক্ত পরিশোধন না করলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
৮. মানসিক অস্পষ্টতা:
*কিডনির সমস্যার কারণে বিষাক্ত উপাদান মস্তিষ্কে প্রভাব ফেললে বিভ্রান্তি বা মনোযোগের অভাব দেখা দিতে পারে।
কিডনি সমস্যা কি কারণে হতে পারে:
১.উত্তেজনামূলক ঔষধ সেবন:
*১৫-২৫ বছরের ছেলেরা অনেকেই না বুঝে উত্তেজনামূলক ঔষধ সেবন করে। এসব ঔষধ অনিয়ন্ত্রিতভাবে সেবন করলে তা কিডনির ওপর সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদে কিডনি বিকল হতে পারে।
২. অনিয়মিত ঘুম:
*প্রতিদিন ৭-৮ ঘন্টা না ঘুমালে কিডনি সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই ঘুমটি হতে হবে রাতে। এখনকার সময়ে অনেকেই রাত জাগে যা কিডনিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
৩. মোটা হওয়ার ঔষধ খাওয়া:
*শরীরের ওজন দ্রুত বাড়ানোর আশায় অনেকেই অস্বাস্থ্যকর এবং অননুমোদিত মোটা হওয়ার ঔষুধের প্রতি ঝুঁকছেন। মোটা হওয়ার ঔষুধে থাকা রাসায়নিক উপাদান কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেম নষ্ট করে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কিডনি বিকলের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. ডায়াবেটিস:
*ডায়াবেটিস হলো ক্রনিক কিডনি রোগের (CKD) প্রধান কারণ। দীর্ঘ সময় ধরে ডায়াবেটিস থাকলে এটি কিডনির রক্তনালী ও ফিল্টারিং সিস্টেমে স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে।
৫. উচ্চ রক্তচাপ:
*অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ কিডনির রক্ত সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।
৬. কিডনির পাথর ও মূত্রনালীর বাধা:
*মূত্রনালীতে পাথর বা বাধার কারণে কিডনিতে চাপ সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনির ক্ষতি করে।
৭. ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI):
*মূত্রনালীর সংক্রমণ যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে পারে।
৮. ঔষুধের অপব্যবহার:
*নির্দিষ্ট ব্যথানাশক, এন্টিবায়োটিক এবং স্টেরয়েডের দীর্ঘমেয়াদি বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কিডনির জন্য ক্ষতিকর।
৯. ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা:
*পানি কম পান করলে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ সঠিকভাবে বের হতে পারে না, যা কিডনিতে চাপ সৃষ্টি করে।
১০. স্থূলতা ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
*অতিরিক্ত ওজন ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস কিডনি সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
১১. হার্টের সমস্যা:
*হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমে গেলে কিডনিতে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ হয় না, যা কিডনির কার্যক্ষমতায় প্রভাব ফেলে।
১২. অতিরিক্ত লবণ ও প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া:
*লবণ ও সোডিয়ামসমৃদ্ধ খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ রক্তচাপ বাড়িয়ে কিডনির ক্ষতি করে।
কিডনি রোগের প্রতিকার: বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
কিডনি রোগ দিন দিন বাড়লেও সময়মতো সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিডনি রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:
কিডনি রোগের প্রতিকার:
১. প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত:
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা (ব্লাড প্রেশার, ব্লাড সুগার এবং কিডনি ফাংশন টেস্ট)।
মূত্রের মাধ্যমে প্রোটিন বা রক্তের উপস্থিতি পরীক্ষা করা।
২. জীবনযাপনে পরিবর্তন:
সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা, যেমন কম লবণ ও প্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ।
পর্যাপ্ত পানি পান এবং শরীর হাইড্রেট রাখা।
ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা।
৩. ঔষধ ও চিকিৎসা:
*চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন।
*উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, কারণ এগুলো কিডনি রোগের প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১. ডায়েট পরিকল্পনা:
*কম প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ সীমিত করা।
*ফল, শাকসবজি, এবং আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানো।
২. ওজন নিয়ন্ত্রণ:
*সঠিক ওজন বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম।
*স্থূলতা কিডনির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়, তাই ওজন নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
৩. চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ:
*যাদের পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের নিয়মিত পরীক্ষা করানো জরুরি।
*ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এড়িয়ে চলা।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা:
কিডনি রোগের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সঠিক জীবনধারা এবং সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনি রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সূত্র: জনকণ্ঠ । Janakantha