প্রচ্ছদ আন্তর্জাতিক ভারতের নতুন আতঙ্ক, পশ্চিমবঙ্গে হাই এলার্ট জারি

ভারতের নতুন আতঙ্ক, পশ্চিমবঙ্গে হাই এলার্ট জারি

১৪০ কোটির দেশ ভারতে ভারতীয়রা ছাড়াও প্রতিবছর উন্নত চিকিৎসা সুযোগ নেন লাখো বিদেশি নাগরিক। তার মধ্যে সব থেকে বেশি বিদেশি নাগরিক হিসেবে ভারতে চিকিৎসা নেন বাংলাদেশিরা। কিন্তু সেই ভারতে এবার ছড়িয়ে পড়েছে নতুন আতঙ্ক। রোগ নয় বরং রোগীদের নতুন আতঙ্কের নাম ভুয়া ওষুধ।

সম্প্রতি, গুণমান যাচাইয়ের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া ওষুধের তালিকা প্রকাশ করেছে সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (সিডিএসসিও)। যেখানে গত তিন মাসে দেশ ৩৯৯টি ওষুধ, ইনজেকশন স্যালাইন কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এছাড়া গত তিন মাসে এসব ওষুধের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ফেল করা ওষুধের সংখ্যা ৬৬টি।

সিডিএসসিও’র রিপোর্টে বলা হয়েছে, গুণমান পরীক্ষায় সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধ, রিঙ্গার ল্যাক্টেট স্যালাইন, সর্দি-কাশি-অ্যালার্জির ওষুধ, রক্ত জমাট বাঁধা ঠেকাতে ব্যবহৃত হেপারিন ইঞ্জেকশন, হৃদরোগ ও স্নায়ু রোগে আক্রান্তদের রক্ত তরল রাখার ওষুধ, প্যারাসিটামল, প্লেটলেট নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধ, ডায়াবেটিসের ওষুধ-সহ গুচ্ছ গুচ্ছ চেনা ওষুধ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। একাধিক ওষুধের নাম রয়েছে, যেগুলো সাধারণ মানুষ প্রতিদিন ব্যবহার করেন। সমস্যা হল এইসব ওষুধের বেশিরভাগই মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে।

এমন ঘটনা সামনে আসতেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার। ড্রাগ কন্ট্রোলের এমন রিপোর্টের জেরে পশ্চিমবঙ্গে জারি করা হয়েছে হাই-এলার্ট।

ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরপরই সরকারিভাবে সব সরকারি হাসপাতাল, ডিস্ট্রিবিউটার ও ড্রাগ ইন্সস্পেক্টরদের সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন-এর রিপোর্ট প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল থেকে শুরু করে দোকানেও প্রকাশ্যে ঝোলাতে হবে অনুত্তীর্ণ সব ওষুধের তালিকা। রাখতে হবে স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটেও। এরপরেও কোথাও ওই সব ওষুধ বেচাকেনা হচ্ছে কিনা, তাতে নজরদারি চালাতে দোকানে আচমকা পরিদর্শন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলকে। গাফিলতি ধরা পড়লে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার কথাও নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে।

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল যেন এসব ওষুধ হাসপাতালের স্টোরে আসার পর তার কিউআর কোড স্ক্যান করে তবেই যেন জনসাধারণকে দেয়। পাশাপাশি হোলসেল ও রিটেল চেন যারা এই ওষুধগুলো সরাসরি বিক্রি করে থাকেন তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সাপ্লাই চেইন থেকে এই নির্দিষ্ট ব্যাচের ওষুধ যেন কিউআর কোড স্ক্যান করে তবেই বিক্রি করা হয়। যদি স্ক্যান করে দেখা যায় কোনো তথ্য মিলছে না, তাহলে ওষুধটি ব্যবহার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওষুধ যদি ভুয়া হয়, সেক্ষেত্রে কিউ আর কোড স্ক্যান করলে দেখাবে ‘Could not verified’।

ধারণা করা হচ্ছে এসব গুণগত মানহীন ও ভেজাল ওষুধের একটা বড় অংশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ভারত থেকে অন্তত ৭০টি দেশে রপ্তানি করা হয় মেড ইন ইন্ডিয়া ওষুধ, ইনজেকশন ও স্যালাইন। নিজের দেশে ভারত এই ওষুধ ব্যবহার আটকানোর জন্য নানান পদক্ষেপ নিলেও রপ্তানি হওয়া ওষুধের ক্ষেত্রে তার ব্যবহার রুখতে ভারত কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা তা জানা যায়নি।

বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’ (বিসিডিএ) পুরো ঘটনার দায় স্বীকার করে রীতিগত সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়েই ওষুধের উপরে ছাড় দিচ্ছেন বহু ব্যবসায়ী। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশ তথা রাজ্যে ভেজাল ওষুধের রমরমা ব্যবসা বাড়ছে। বিসিডিএ-র সম্পাদক পৃথ্বী বসু বলেন, ‘ওষুধ সস্তায় পাওয়ার জন্য সবার আগে জিএসটি প্রত্যাহার করতে হবে। কেন্দ্রই একমাত্র পারে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার উপরে চাপ তৈরি করে দাম আয়ত্তে রাখতে।

এদিকে রাজ্য জুড়ে ‘জাল ও বাতিল’ ওষুধের রমরমার অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নেমেছে বাম দল সিপিআইএম। একই অভিযোগে কলকাতায় ড্রাগস কন্ট্রোলের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছে কংগ্রেস। ঘরে-বাইরে সরাসরি চাপের মুখে দেশজুড়ে জাল ওষুধ কারবারিদের খোঁজে শুরু হয়েছে তল্লাশি। উদ্ধার হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকার জাল ও গুণগত মানহীন ওষুধ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ৬ জনকে।

চিকিৎসক অধ্যাপক ডক্টর কে এ মহিত বলেন, রাতারাতি এই জাল ও গুণগত মানহীন এসব ওষুধের সিন্ডিকেট তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে হয়েছে এবং যে ওষুধ ইতিমধ্যেই মানুষজন গ্রহণ করেছেন। এতে রোগমুক্তি তো ঘটেই নিয়ে উল্টে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছে রোগীরা। শুধু এলোপ্যাথি নয় হোমিওপ্যাথি আয়ুর্বেদিক সবক্ষেত্রেই নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। এই চিকিৎসক বলেন বাইরের দেশে এই সব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ড হয়। সরকারের শক্ত হাতে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। সরকারের উচিত ফাস্ট ফেজ সেকেন্ড ফেস করে ট্রায়াল মেডিসিনে যেভাবে বাজারে যাচ্ছে সেদিকেও কড়া নজর দেওয়া।

ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সহ-সভাপতি ডাক্তার সুজয় চক্রবর্তী বলেন, চিকিৎসক হিসেবে এটা খুবই চিন্তার বিষয় এবং সমস্যার। আমরা যখন কোন রোগীকে ওষুধ দিয়ে থাকি এবং সেই ওষুধে যদি কাজ না হয় সেক্ষেত্রে আমরাও সমস্যায় পড়তে পারি। ওষুধের গুণগত মান খারাপ না রোগীর শরীরে ওষুধ কাজে আসছে না সেই কনফিউশন তৈরি হতে পারে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশ্বজোড়া ভারতের যে সুনাম রয়েছে সেই সুনাম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারতে খুব ভালো ডাক্তার আছে তাই বিদেশ থেকে রোগীরা ভারতে আসেন। কিন্তু ওষুধের সমস্যার কারণে তারা যদি দেখেন যে চিকিৎসা করিয়ে তারা ফল পাচ্ছেন না। তারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। শিক্ষা স্বাস্থ্য ও দেশের জাতীয় স্তম্ভ সেখানে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই যদি এত বড় জালিয়াতি চলে এবং এই ধরনের অপরাধকে কেন্দ্রীয় সরকার যদি ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে বিচার না করে গুরুতর পদক্ষেপ না নেয়, সেক্ষেত্রে মানুষ সমস্যায় পড়বে এবং একসময় পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।

কেন্দ্রীয় ওষুধ সংস্থার তালিকা অনুযায়ী যেসব ওষুধ ব্যবহারে অযোগ্য বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে-

১. রক্ত জমাট বাধা ঠেকাতে ব্যবহৃত হওয়া ওষুধ
২. হাড়ের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হওয়া ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট
৩. বাতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হওয়া ইঞ্জেকশন
৪. শরীরে আয়রনের ঘাটতি বাড়াতে ব্যবহৃত হওয়া ইঞ্জেকশন
৫. অস্ত্রোপচারের সময় ব্যথা কমাতে ব্যবহার হওয়া ইঞ্জেকশন
৬. ডায়াবেটিসের ওষুধ
৭. ফুসফুসের অসুখে ব্যবহৃত হওয়া এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন
৮. প্যাকেটজাত খাবার দীর্ঘদিন একই রকম রাখতে ব্যবহৃত হওয়া ওষুধ
৯. কাফ সিরাপ
১০. চোখের সংক্রমণ, কর্নিয়ার সমস্যায় ব্যবহৃত হওয়া ওষুধ
১১. ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহৃত ওষুধ
১২. সাধারণ স্যালাইন
১৩. খিঁচুনি কমাতে ব্যবহৃত ওষুধ
১৪. ভিটামিন বি-র ঘাটতি ঠেকাতে ব্যবহৃত ওষুধ
১৫. খাদ্যনালীর সমস্যা সংক্রান্ত চিকিৎসার ওষুধ
১৬. বসন্তের টিকা
১৭. ক্ষুদ্রান্তের সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ
১৮. ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহৃত ইঞ্জেকশন
১৯. ক্যালসিয়ামেক ইঞ্জেকশন
২০. ফোলা কমানোর ইঞ্জেকশন
২১. বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ট্যাবলেট

সূত্র: চ্যানেল২৪

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।