প্রচ্ছদ দেশজুড়ে নির্যাতনের বন্দিদশা থেকে মিলেছে মুক্তি, এখন বাঁচার সংগ্রাম

নির্যাতনের বন্দিদশা থেকে মিলেছে মুক্তি, এখন বাঁচার সংগ্রাম

দেশজুড়ে: ‘বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি, কেহ রহিবে না বন্দি কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীকে জাগ্রত করতে লাইনগুলো লিখেছিলেন তার নারী কবিতায়। কবির লেখা নারী কবিতার মতো ডঙ্কা বাজিয়ে নির্যাতনের বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছেন আয়েশা আক্তার। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এখন তার প্রতিটি দিনই সংগ্রামের।

আয়েশা আক্তারের জীবন সংগ্রাম সমাজের অন্য নারীদের তুলনায় ভিন্ন। তার প্রকৃত নাম গীতা রায়। তিনি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও বাংলা বাজার গ্রামের শান্তি রঞ্জন বাছার ও পার্বতী বাছারের মেয়ে। জীবনের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের পর এখন তিনি আয়েশা আক্তার নামেই সর্বাধিক পরিচিত।

আয়েশা, তার ছেলে-মেয়ে ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আয়েশার জীবনের সঙ্গে অন্য কোনো নারীর জীবনের হয়তো মিল নেই। মা-বাবার মতামতে তার বিয়ে হয়েছিল স্বপন রায় নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পর দেখা যায় স্বপন রায় মাদকাসক্ত ও জুয়াড়ি। প্রতিদিন নেশায় বুদ হয়ে জুয়ায় হেরে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে মারধর করতেন স্বপন রায়। শুধু মারধর করেই ক্ষ্যান্ত হতেন না স্বপন, সিগারেট ও কয়েলের আগুন দিয়ে ছেঁকাও দিতেন আয়েশার শরীরে। সিগারেটের সেই আগুনে পোড়া পাঁচ শতাধিকের ওপরে চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে তার শরীরে। এসব নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পাঁচ বছর আগে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আয়েশা স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে আসেন।

স্বামীর সংসার ছেড়ে আসায় জায়গা হয়নি বাবার বাড়িতেও। এরপরই শুরু হয় তার একাকী জীবন সংগ্রাম। তার এমনও দিন গেছে মেয়ের জন্মদিনে ঘরে চাল ডাল কিছুই নেই। ডাল ছাড়া শুধু খুদের সঙ্গে হলুদ-মরিচ মিশিয়ে রান্না করে দিয়ে মেয়েকে বলেছেন, এটাই তোমার জন্মদিনের উপহার। সারাদিন না খাওয়া ছোট মেয়ে ফাতেমা বুঝতে না পেরে এমন খাবারই আনন্দ সহকারে খেয়েছে আর আয়েশা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে চোখের পানি ছেড়েছেন। এমন কষ্ট দূর করতে ধার-দেনা করে শরীয়তপুর শহরে একটি দোকান নিয়ে সেলাই মেশিনে জামা-কাপড় তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি।

দোকানে উপার্জিত টাকা দিয়ে ছেলে-মেয়েকে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করিয়েছেন। কিন্তু পুঁজির অভাবে নিজের দোকানে কাপড় না থাকায় ক্রেতারা তেমন আসত না তার দোকানে। কয়েক মাসের দোকান ভাড়া বাকি পড়ে গেলে তিনি দোকান ছাড়তে বাধ্য হন। এখন তিনি জেলার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে তুলাসার স্কুল সংলগ্ন মোতালেব মোড়লের বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন। এই বাসাতেই তিনি একটি মেশিন দিয়ে নারীদের কাপড় সেলাই করে উপার্জন করেন। কাপড় সেলাই করে যে উপার্জন হয়, তাতে কোনোদিন তার রান্না হয়, কোনোদিন হয় না। তবুও ছেলে-মেয়ের সুখের আশায় তাদের পড়াশোনার খরচও বহন করে চলছেন আয়েশা আক্তার। সংগ্রামী আয়েশা আক্তার প্রায় দেড় বছর আগে ছেলে-মেয়েসহ ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। আয়েশা ও তার প্রতিবেশীদের দাবি- নারীরা যদি আয়েশার কাছে কাপড় সেলাই করতেন, তাহলে তার এসব কষ্ট একটু হলেও দূর হতো।

আয়েশা আক্তার তার একাকী জীবনের সংগ্রাম নিয়ে বলেন, বাবা-মা আমাকে স্বপন রায় নামে একজনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। জুয়ায় হেরে মাদকাসক্ত হয়ে সে আমাকে নির্যাতন করত। সিগারেট, কয়েলের আগুন দিয়ে আমার শরীরে আঘাত করত। তার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও জায়গা হয়নি। পরে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি। এরপর একজনকে ভালোবেসে বিয়েও করেছিলাম। শর্ত ছিল সে আমার ছেলে-মেয়েকে মেনে নেবে কিন্তু তার পরিবার মানেনি বলে সেও মেনে নেয়নি আর। এরপর কাপড় সেলাই করে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছি। চাইলেই প্রেমিকের কাছে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু নারী মানে মা, ছেলে-মেয়ের কী হবে এটা ভেবে আর যাইনি। বাজারে একটি দোকান নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রেতার অভাবে দোকান ভাড়া বাকি পড়ে গিয়েছিল প্রায় পাঁচ মাসের। দোকান মালিক আমার ভাড়ার জন্য একমাত্র সম্বল সেলাই মেশিনও আটকে দিয়েছিল। পরে আংগারিয়ার এক ভাই দয়া করে ওই ভাড়া মিটিয়ে মেশিন এনে দিয়েছেন। এখন বাড়িতেই সেলাইয়ের কাজ করি। বাড়িতে কাজ করি বলে তেমন ক্রেতা আসে না। অনেকে জানেনও না। যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে কোনো মতে খেয়ে বেঁচে আছি। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ দিতে কষ্ট হয়। তবুও পড়াশোনার জন্য খরচ করি, যদি আমার সন্তানেরা একটু সুখের মুখ দেখতে পায়, এই আশায়।

তিনি আরও বলেন, আমার ছোট্ট মেয়েটার তিন বছর আগের জন্মদিনে ঘরে এক মুঠো চাল-ডালও ছিল না। একজনের কাছে কাপড় সেলাই বাবদ সামান্য কিছু টাকা পাওনা ছিল আমার। সেই টাকা চেয়েও পাইনি। ওইদিন আমি মেয়েকে ডাল ছাড়া চালের সঙ্গে হলুদ-মরিচ দিয়ে খিচুরির মতো করে রান্না করে দিয়েছিলাম। সারাদিন না খাওয়া আমার অবুঝ মেয়ে না বুঝেই সেই খাবার খেয়ে আনন্দ করেছিল। আমি ফাতেমার খাওয়া দেখছিলাম আর কাঁদছিলাম। ছেলে ইব্রাহীম দুষ্টুমি করে ফাতেমাকে বলেছিল এটাই তোমার জন্মদিনের স্পেশাল খাবার। এই কথা মনে হলে এখনও কান্না পায় আমার। আমার এই কষ্ট কী শেষ হবে না?

ধর্ম পরিবর্তনের বিষয়ে আয়েশা আক্তার বলেন, নিজেদের ভালো লাগা থেকে ছেলে-মেয়ে নিয়ে প্রায় দেড় বছর আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখছি, তিনি একদিন আমাদের কষ্ট দূর করবেন। ইচ্ছে আছে আমার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ ছেলে-মেয়ের জন্ম নিবন্ধনের নাম পরিবর্তন করার। কিন্তু বিভিন্ন ঝামেলার কারণে এসব পরিবর্তন করতে পারছি না। এসব পরিবর্তন করতে যদি কেউ সাহায্য করত, তাহলে উপকৃত হতাম।

নারী দিবস নিয়ে অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আয়েশা আক্তার বলেন, আমার কাছে প্রতিটি দিনই নারী দিবস। কেননা আমি নারী, আমি মা। প্রতিটি দিনই আমি ছেলে-মেয়ের জন্য কষ্ট করি। নারী দিবসে একটি কথা বলতে চাই, নির্যাতিত সকল নারী জেগে উঠুক, নির্যাতনের প্রতিবাদ করুক, সকলে সংগ্রাম করুক। নির্যাতন সহ্য করার চেয়ে একাকী সংগ্রামী জীবন আনন্দের। নারী দিবসে আমি মা-বোনদের প্রতি অনুরোধ জানাই, তারা যেন আমার বাসায় এসে কাপড় সেলাই করতে দেন, তাহলে আমি ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালো থাকতে পারব, বাঁচতে পারব।

শরীয়তপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র বিল্লাল হোসেন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরীয়তপুর পৌরসভার বর্তমান বাসিন্দা আয়েশা আক্তারকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আয়েশা একজন সংগ্রামী নারী। স্বামী, বাবা-মা কেউ তার পাশে না থাকলেও তিনি নিজে সেলাই মেশিন দিয়ে উপার্জন করে ছেলে-মেয়ের খরচ বহন করছেন। তার যে কোনো সমস্যা সমাধানে শরীয়তপুর পৌরসভা পাশে থাকবে।