
দেশজুড়ে: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দেশের আর্থিক খাতের সংকট কাটাতে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই ব্যাংক ঋণের সুদে ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সুদহার বৃদ্ধিতে এ সময় সব ব্যাংক আমানতেও সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে মানুষের হাতে থাকা টাকা ব্যাংকে যেতে শুরু করে। কিন্তু গত ডিসেম্বরে সংকট কাটাতে ব্যাংক একীভূতকরণের প্রথম ধাপ হিসেবে প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংক একীভূতকরণ করা নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের গ্রাহকরা আতঙ্কে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিতে শুরু করে। তাই অন্যান্য ব্যাংকে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়লেও সরকারি ব্যাংকে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্যের (নগদ টাকা) পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। কিন্তু ফেব্রুয়ারি শেষে ওই ব্যাংকগুলোর নগদ কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের ৮ মাসে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে নগদ কমেছে ৭ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। একই অবস্থা রাষ্ট্রের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোরও। অর্থবছরের শুরুতে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো হাতে নগদ টাকা ছিল ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। কিন্তু ফেব্রুয়ারি শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর তারল্য কমেছে ২৩৯ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, মূলত চারটি কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একীভূত আতঙ্কে গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়া, সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকায় ডলার কেনায় টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আটকে যাওয়া, বিতরণ করা ঋণ আদায় না হওয়া ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর অর্থ আটকে রয়েছে ওইসব খাতে। ফলে ঋণ বিতরণ করতে গিয়ে টাকার জোগান দিতে সমস্যা হচ্ছে। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে গিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
সূত্র বলছে, গত ডিসেম্বর থেকেই দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূত হওয়া নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে বেসিক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ (বিডিবিএল) সরকারি ব্যাংকগুলোর একীভূত হওয়া নিয়ে বেশি আলোচনা শুরু হয়েছে। সে অনুযায়ী এরই মধ্যে কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল এবং বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংকের একীভূতকরণের প্রক্রিয়াও চলছে। যদিও সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে রাজি নয় বেসিক ব্যাংক পর্ষদ। এতে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় গ্রাহকরা আমানত তুলে নিচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক খাতে তারল্য বাড়লেও সরকারি ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার প্রবাহ কমেছে। তবে মার্চ ও এপ্রিলে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে আমানত আরও কমেছে বলেও জানা গেছে। সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট এক দিনে হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে চলা লুটপাটের কারণে ব্যাংক থেকে যেসব অর্থ বেরিয়েছে, সেগুলো ফেরত আসছে না। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়া চড়া মূল্যস্ফীতি ও আস্থার সংকটে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখছে না। একটি শ্রেণি টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোও তারল্য ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে প্রচলিত ধারার বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ ছিল ১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। ৮ মাসে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ বেড়েছে ১৫ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। জুন শেষে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ ছিল ৩৭ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। ফ্রেব্রুয়ারি শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ বেড়েছে ২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া অর্থবছরের ৮ মাসে বিদেশি ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ বেড়েছে ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে তাদের হাতে নগদ ছিল ৫০ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা।