প্রচ্ছদ দেশজুড়ে আশ্রমের ভেতর ‘ইয়াবা’ খেয়ে বয়স্কদের পেটান মিল্টন

আশ্রমের ভেতর ‘ইয়াবা’ খেয়ে বয়স্কদের পেটান মিল্টন

দেশজুড়ে: মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর থেকেই ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ মিল্টন সমাদ্দার। তাকে নিয়ে এরই মধ্যে দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম সরব হয়েছে। মিল্টনকে নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, ততই বেরিয়ে আসছে আশ্রমের আড়ালে ভয়ংকর সব ঘটনা। এর মধ্যে রয়েছে গভীর রাতে আশ্রমে বসে মদ ও ইয়াবা সেবনের পর মাতাল হয়ে বয়স্ক মানুষদের মারধরের মতো গুরুতর অভিযোগ।

টর্চার সেলে আটকে মারধরের পর এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। কল্যাণপুর এবং দক্ষিণ পাইকপাড়ার সাধারণ মানুষ মিল্টন সমাদ্দারের ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকতেন। কারণ, কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে আশ্রমে ঢুকিয়ে মারধর করা হয়। সেখানেই শেষ নয়, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিও করা হয় অনেককে। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে করা হয় আপসরফা। গতকাল মঙ্গলবার দিনভর রাজধানীর কল্যাণপুর এবং দক্ষিণ পাইকপাড়া এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ায় মিল্টনের আশ্রমের আশপাশের অর্ধশতাধিক মানুষের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সবার মধ্যেই এক ধরনের চাপা আতঙ্ক দেখা গেছে। তবে এতদিন চুপ থাকলেও কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, মিল্টনের আশ্রমের নানা অনিয়মের বিষয়ে সবাই জানলেও এতদিন কেউ ভয়ে মুখ খোলেননি। প্রায় প্রতিদিনই তার আশ্রমে লোক মারা যায়। তবে সেসব লাশ কী করা হয়, তা কেউ জানেন না। এলাকার কাউকে আশ্রমের ভেতর ঢুকতেও দেওয়া হতো না। পান থেকে চুন খসলেই যাকে-তাকে আশ্রমে ঢুকিয়ে মারধর করা হতো। এরপর উল্টো মিথ্যা মামলা দিয়ে করা হতো হয়রানি। তার সঙ্গে অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তির সখ্য থাকায় থানায় অভিযোগ দিলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিত না। উল্টো যারা অভিযোগ দিতেন, তাদেরই হয়রানি করা হতো। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরও তার কাছে ছিলেন অসহায়। মিরপুর মডেল থানায় দেওয়া বেশ কয়েকটি অভিযোগের কপি কালবেলাকে দেখিয়েছেন স্থানীয়রা।

ওই এলাকায় গিয়ে খোঁজ পাওয়া যায় সুমি আক্তারের। ২০২০ সালের নভেম্বরে মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে ইনজেকশন দিতে গিয়ে বেধড়ক মারধরের শিকার হন তার বাবা মো. মির হোসেন। এর কয়েকদিন পর (২৬ নভেম্বর) তিনি মারা যান।

সুমি আক্তার বলেন, ‘আমার বাবার কিডনিতে সমস্যা ছিল। হাসপাতাল থেকে ইনজেকশন লিখে দিয়েছিল। বাবা সেদিন ক্যানোলা করানোর জন্য মিল্টনের আশ্রমে গিয়েছিলেন। মিল্টন ক্যানোলা করাতে ১ হাজার টাকা চান। একটি ক্যানোলা করাতে এত টাকা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে একপর্যায়ে বাবাকে বেধড়ক মারধর করা হয়।’

সুমি আরও বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে ঘটনা শুনে আমি মিল্টনের আশ্রমে গিয়ে প্রতিবাদ করি। সেসময় মিল্টনকে একটা থাপ্পড়ও দিয়েছিলাম। এরপর আমরা থানায় গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। তিন দিন পর উল্টো আমাদের নামে চাঁদাবাজির মামলা দেন মিল্টন। এর জেরে দেড় মাস আমাদের পালিয়ে থাকতে হয়। পরে গ্রামের জমি বিক্রি করে এনে পুলিশকে দেড় লাখ এবং মিল্টনকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে মীমাংসা করি।’

মিল্টন সমাদ্দারকে ইয়াবা সরবরাহ করতেন—এমন দাবি আসাদুজ্জামান তাপস নামে এক ব্যক্তির। তিনি বলেন, ‘একসময় মিল্টনের সঙ্গে তার আশ্রমে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতাম। দুবার আমার বাসায় বসেও আমরা ইয়াবা সেবন করেছি। আমি মিল্টনকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২৫টি করে ইয়াবা এনে দিতাম। এ ছাড়া মিল্টন প্রচুর মদ পান করেন।’

তাপস আরও বলেন, ‘একবার মিল্টন আমাকে ১৫টি ইয়াবা আনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু স্পটে ঝামেলা হওয়ায় টাকা দিলেও জিনিস আনতে পারিনি। যে কারণে মিল্টন আমাকে মারধর করেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালে কল্যাণপুরে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে ঝামেলার মূলে ছিল ইয়াবা নিয়ে দ্বন্দ্ব। টাকা নিয়েও ইয়াবা না দেওয়ায় তাপসকে আটকিয়ে মারধর করেন মিল্টন। পরে তাপসের পক্ষ নিয়ে সেখানে যান স্থানীয় যুবলীগ নেতা রাহাত। কিন্তু তাকেও আশ্রমে আটকে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে রাহাতের সহযোগীরা গিয়ে মিল্টনসহ আশ্রমের লোকজনকে মারধর করেন। এ নিয়ে মিল্টন সমাদ্দার মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন। দুই বছর মামলা চালানোর পর এজাহারভুক্ত ১১ আসামির প্রায় সবার কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নিয়ে মুচলেকা দিয়ে মামলা তুলে নেন মিল্টন।

‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের উল্টোপাশের বাড়িটি দেখাশোনা করেন মো. সুজন নামের এক যুবক। ঢাকা পলিটেকনিকে অটোমোবাইল টেকনোলজির শিক্ষার্থী সুজন কালবেলাকে বলেন, ‘মিল্টন আশ্রমের ভেতর নিয়মিত মদ পান করেন। একবার থার্টিফার্স্ট নাইটে তাকে লোকজন নিয়ে মদপানসহ ফুর্তি করতে নিজের চোখে দেখেছি।’

তিনি বলেন, ‘মিল্টন নিয়মিত মদ ও ইয়াবা সেবন করেন। ডোপ টেস্ট করলেই সব বেরিয়ে আসবে।’ এ ছাড়া গভীর রাতে নেশা করে আশ্রমের বৃদ্ধ ও শিশুদের মারধর করা হয় বলেও জানান সুজন।

পাশেই আরেকটি বাসায় থাকেন আহমেদ মোস্তফা শুভ নামের এক যুবক। তিনি বলেন, ‘মিল্টনের অত্যাচারে রাতে আমরা ঘুমাতে পারি না। প্রায় প্রতি রাতেই ১২টার পর বয়স্ক ও শিশুদের বেধড়ক মারধর করা হয়। মারধরের ফলে আশ্রমের বাসিন্দারা চিৎকার চেঁচামেচি করেন। তাকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও তিনি কারও কথা শোনেন না, কাউকে তোয়াক্কা করেন না।’

স্থানীয় আরেক নারী বলেন, ‘প্রায় প্রতি রাতেই তার আশ্রম থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যায়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মিল্টন বলেন, না মারলে তাদের মানানো যায় না।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান বলেন, ‘আসলে তার আশ্রমে কী হয়, তার কিছুই আমরা জানি না। সবসময়ই মনে হতো, উনি কোনো কিছু লুকাতে চান। ঢাকা শহরে কেউ মারা গেলে তার সনদ দেওয়া হয় স্থানীয় কাউন্সিলর অফিস থেকে। কিন্তু মিল্টন আমার কাছে কখনো সনদের জন্য আসেননি। বেওয়ারিশ মরদেহ হলেও কাউন্সিলর অফিস থেকে দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে ঢাকার যে কোনো সরকারি কবরস্থানে দাফন করা যায়। মিল্টন সমাদ্দার ঘুষ দিয়ে মরদেহ দাফনের যে দাবি করেছেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য জানতে মঙ্গলবার দুপুরে মিল্টন সমাদ্দারের দক্ষিণ পাইকপাড়ার আশ্রমে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।