দেশজুড়ে: পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে এসেছে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের নাম। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। কোটচাঁদপুরের নির্জন এলাকায় বিলাসবহুল একটি বাগানবাড়ি রয়েছে শাহীনের। সেখানে আনাগোনা ছিল অনেক প্রভাবশালীর। এ বাড়িতেই শাহীনের সঙ্গে একান্তে আলাপ করতেন এমপি আনার। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ উঠলেও তা অস্বীকার করেছেন শাহীন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কোটচাঁদপুর শহর থেকে সাড়ে ৫ কিলোমিটার দূরে এলাঙ্গী গ্রামের নির্জন মাঠ। মাঠ পেরিয়ে চারপাশে জঙ্গল, কাঁটাতার ও ফুলেঘেরা বেড়া। ভেতরের আমবাগানের এক প্রান্তে বিলাসবহুল দ্বিতল বাড়ি, যা দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বাড়ির দ্বিতীয় তলার বেশিরভাগই কাচঘেরা। ঝুলছে বড় বড় পর্দা। আরেক প্রান্তে দেখা যায়, একটি টিনশেড। যার সামনে ছাউনির নিচে রাখা আছে সাদা রঙের গাড়ি। চার বছর আগে ৩০ বিঘা জমিতে এই বাংলো বাড়িটি গড়ে তুলেছিলেন শাহীন।
এলাকার মানুষ জানান, গত এক বছরের মধ্যে শাহীন ছয় মাস নিউইয়র্কে, আর ছয় মাস বাংলাদেশে ছিলেন। গ্রামে এলে তিনি বাগানবাড়িতেই থাকতেন। তবে বাড়ির ভেতরে কী হতো, সেটি কখনো দেখতে পারেনি তারা। তবে মাঝেমধ্যেই রাতের বেলায় বড় বড় গাড়ি ঢুকত সেখানে। বাগানবাড়ি থেকে বেজে উঠত গান। তবে থানা-পুলিশ কিংবা আইনের ভয়ে কেউই কখনো মুখ খোলেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাঙ্গী গ্রামের আসাদুজ্জামানের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে চতুর্থ সন্তান শাহীন। তার বাবা আড়তদারি ব্যবসা এবং কৃষিকাজ করতেন। তার বড় ছেলে সহিদুজ্জামান সেলিম থাকেন কোটচাঁদপুর শহরের বাজারপাড়ার বাড়িতে। তিনি কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র। ব্যবসা করেন। আরেক ছেলে মনিরুজ্জামান মনির ১৯৮৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে থাকেন, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে খুকু থাকেন কখনো কানাডায়, আবার কখনো ঢাকায়। ছোট ছেলে আক্তারুজ্জামান শাহীন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। আরেক মেয়ে এলিন থাকেন ঢাকায়।
শাহীন কোটচাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কেএমএইজ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। কলেজে ভর্তির পর মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। পরে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে লেখাপড়া শেষে জাহাজে চাকরি নেন। চাকরির দুই বছরের মাথায় ওপি-ওয়ান ভিসা পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭৯ ইস্ট সেভেন্থ স্ট্রিট ব্রুকলিন এলাকায় শাহীনের বাড়ি রয়েছে, সেখানকার নাগরিকও তিনি। তবে তিনি কত সালে আমেরিকায় যান, তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি তার বড় ভাই সেলিম। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর থেকেই শাহীন নানা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। এলাকার মানুষ জানত, বাংলাদেশ, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করেন। এসব দেশে তার যাতায়াতও ছিল। গত পৌরসভা নির্বাচনের সময় ভাই সেলিমের পক্ষে বেশ সক্রিয় ছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হুমকি-ধমকি ও হামলা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন সেলিম।
শাহীনের বাগানবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির খয়েরি রঙের গেটটি তালাবদ্ধ। ডানপাশে ওপরে লাগানো রয়েছে দুটি সিসি ক্যামেরা। এ ছাড়া বাগানবাড়ির চারপাশে অনেক সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এই বাগানবাড়ির ভেতরে রয়েছে পুকুর, গরুর খামার। রিসোর্ট হিসেবেও এটিকে রূপান্তরের পরিকল্পনা ছিল তার। বাড়ির দারোয়ানকে পাওয়া না গেলেও সফি উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘যাওয়া-আসার পথে দেখি গেটে লেখা, কুকুর হইতে সাবধান। আর ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। তবে কিছু সময় লোকজন আসে, ভেতরে ঢোকে। মাঝে মাঝে রাতে গানবাজনা হয়, মাইক বাজে। প্রায়ই গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢোকে। দিনে ও রাতের বেলায় কেউ মোটরসাইকেল নিয়েও ঢোকে। মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম রসুল বলেন, আনার ও শাহীনের বন্ধুত্ব প্রায় ৩০ বছরের। পাশের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামে শাহীনের ওই বাংলোয় প্রথমবার তিনি গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। তিন-চার মাস আগে শেষবার এমপি আনার তাকে ওই বাংলোয় নিয়ে গিয়েছিলেন। একদিন দর্শনা থেকে বাড়ি ফেরার পথে আনার তাকে বলেছিলেন, চলো বন্ধু শাহীনের সঙ্গে দেখা করে আসি। এরপর তারা দুজন ওই বাংলোয় যান। আনার একান্তে শাহীনের সঙ্গে কথা বলেন। তবে রসুল বাইরে বাংলোর মধ্যে একটি কক্ষে বসে অপেক্ষা করেছিলেন।
রসুল বলেন, বাংলো দেখে তিনি হতবাক হন, এই গ্রামের মধ্যে এত ভিআইপি বাংলো। যেখানে বিদেশি কুকুর, অনেক কর্মচারী, ভিআইপি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। আনোয়ারুল তাকে বলেছিলেন, শাহীন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। এখানে বেড়াতে এলে এই বাংলোতে অবস্থান করেন। কোটচাঁদপুরের মানুষ শাহীনের অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে। এতদিন মানুষ তার নির্যাতন সহ্য করেছে। দেড় বছর আগে কোটচাঁদপুরে দুটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই শাহীন জড়িত বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। এলাকাবাসী বলছেন, বাগানবাড়িতে বিভিন্ন সময় নামিদামি অনেক লোক আসা-যাওয়া করেন। রাতে সেখানে মদের আড্ডা আর সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে আমোদ-প্রমোদ করা হয়। শাহীন নিজেই এলাকায় সালিশ-দরবার করতেন। সেখানে তার রায়ই চূড়ান্ত হতো। কেউ বিরোধিতা করলে পুলিশ দিয়ে তাকে হয়রানি করার অভিযোগও রয়েছে। তবে শাহীন এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন, তার বিরুদ্ধে থানা-পুলিশে অভিযোগ দিয়ে লাভ হতো না। শাহীন গত দেড় দশকে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
শাহীনের বড় ভাই পৌর মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, শাহীনের সঙ্গে সর্বশেষ ছয় দিন আগে কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপে। তবে শাহীন তখন কোন দেশে ছিল জানি না। শাহীনের স্ত্রী-সন্তানরা মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসে। শাহীন এলাঙ্গীতে বাগানবাড়ি করার পর আমার বাড়িতেও থাকে না। সর্বশেষ ছয় মাস আগে থেকেছে এক রাত। তিনি বলেন, শাহীন এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটাবে এটা বিশ্বাস হয়নি আমাদের। তবে প্রশাসনের উচিত সঠিক তদন্ত করা। যদি ভাই দোষী হয় তাহলে প্রচলিত আইনে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক—এটা আমরা চাই। এমপি আনারের সঙ্গে তার একটা পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, যেটা আমি জানতে পেরেছি গত ৫-৬ বছর আগে। তবে কী ব্যবসা ছিল, তা আমরা কখনো জানতে পারিনি। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর থানার ওসি সৈয়দ আল মামুন জানান, তিনি নিজেও শাহিনের বাগানবাড়িতে গেছেন, সেখানে সুইমিংপুল থেকে শুরু করে মাছের পুকুর, খেলার মাঠ, চা বাগান, ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং বিদেশি কুকুর রয়েছে। সেখানে উঁচুতলার লোকরা আসা-যাওয়া করত বলে শুনেছি। অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান শাহীন দাবি করেন তাকে ফাঁসানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে সাংবাদিকদের জানান, ‘আনার হত্যার ঘটনায় আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। ঘটনার সময় আমি ভারতে ছিলাম না। মানুষ দেশে অনেক কথাই বলে। যদি কোনো প্রমাণ থাকে তাহলে দেখাক। আমার বন্ধু আনার ফ্ল্যাটের চাবি চেয়েছিল। সে আমার সঙ্গে কয়েকবার চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিল। একপর্যায়ে যখন বুঝেছি, বাংলাদেশের পুলিশ আমাকে নিয়ে কথা বলছে। আমার বন্ধু যখন রেসপন্স করছে না, তখন আমি চলে এসেছি যুক্তরাষ্ট্রে। এখন আমাকে বলা হচ্ছে মাস্টারমাইন্ড। বাংলাদেশ সরকার বা পুলিশের কাছে কোনো ডকুমেন্ট থাকলে তারা যুক্তরাষ্ট্রে দিক। এখানে প্রমাণ হলে সেটা হবে।’ ফ্ল্যাটের ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যদি ফ্ল্যাট ভাড়া নিই, আমি কী করেই আমার ফ্ল্যাটে এ ধরনের কাজ করব? আমার পাসপোর্ট রেকর্ড দেখলে দেখা যাবে, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখন বলা হচ্ছে, আমি ৫ কোটি টাকা দিয়েছি। কীভাবে আমি ৫ কোটি টাকা দিয়েছি? কোথা থেকে পেলাম আমি এত টাকা? এখন এগুলো মানুষ বললে আমার শোনা ছাড়া কী করার আছে?’
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |