প্রচ্ছদ খেলাধুলা বাংলাদেশের ক্রিকেট দলেও ‘কোটা পদ্ধতি’

বাংলাদেশের ক্রিকেট দলেও ‘কোটা পদ্ধতি’

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন ছাত্ররা। কোটার বদলে মেধার ভিত্তিতে হবে কর্মসংস্থান এই দাবিতে পালন করা হয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’। এরই মধ্যে শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অ্যাকাডেমির সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়াগামী হাই পারফরম্যান্স দলের সদস্যদের নাম। তিন সংস্করণের জন্য ঘোষিত দলেও যেন আছে অদৃশ্য কোটা, যার জেরে ক্যাম্পে না থেকেও কেউ কেউ ডাক পেয়েছেন দলে।

এইচপি ক্যাম্পটা বিসিবি শুরু করেছিল সাবেক কোচ রিচার্ড ম্যাকিন্সের সময়ে, ২০০৩ সালে। মূলত অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের জন্যই এই বিভাগের সৃষ্টি। সে সময় ম্যাকিন্সের ছাত্র ছিলেন সাকিব আল হাসানসহ অনেকেই যারা বাংলাদেশ দলে দীর্ঘসময় খেলেছেন। সাকিব নিজেও এইচপি নিয়ে বলেছিলেন, ‘ও (ম্যাকিন্স) এইচপির যে কাজ করেছে তার সুফল আমরা পাচ্ছি। ওই রকম এইচপি থাকাটা খুব দরকার। আমি নিশ্চিত না, তবে মনে হয়, ওর সময়ের চেয়ে এখনকার এইচপির অনেক পার্থক্য।’

কথাগুলো সাকিব বলেছিলেন ২০০৯ সালে। ১৫ বছর পেরিয়েও এইচপির সঠিক কোনো কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি বিসিবি।

২০১৯ সালে বিসিবিতে এইচপির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক নাঈমুর রহমান বলেছিলেন, ‘অ্যাকাডেমি আর এইচপি কিন্তু আলাদা। এবার আমরা বয়সের সীমা দিয়ে এইচপিকে এইচপির মতো করে পরিচালনা করব। আমরা বয়সের কথা চিন্তা করেছি, যেহেতু ইমারজিং কাপের মতো একটা টুর্নামেন্ট হয় অনূর্ধ্ব-২৩ দের নিয়ে, সেটা বিবেচনা করে অনূর্ধ্ব-২৩’র মতো করে আমরা সাজাচ্ছি।’

কিন্তু এসব কিছুই বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়াতে বিসিবির এইচপি নামে যে তিনটা দল যাচ্ছে, যে সফরটি খোদ বিসিবি সভাপতির ভাষাতেই ‘অত্যন্ত ব্যয়বহুল সফর’, সেই সফরের দলগুলো হয়েছে জগাখিচুড়ির মতো। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলে আসা তানজিদ হাসান তামিম এবং ট্রাভেলিং রিজার্ভ হিসেবে দলের সঙ্গে থাকা আফিফ হোসেনকে নেওয়া হয়েছে এইচপির ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি দলে।

আফিফকে করা হয়েছে অধিনায়ক। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া ২৮ বছর বয়সী আবু হায়দার রনিকেও নেওয়া হয়েছে। একই দলে আছে এই বছরে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা মাহফুজুর রহমান রাব্বি, জিশান আলমও। পাকিস্তান শাহিনস বা ‘এ’ দলের বিপক্ষে দুটো চারদিনের ম্যাচের জন্য এইচপি দলে আছেন ১৩টা করে টেস্ট খেলে ফেলা সাদমান ইসলাম এবং মাহমুদুল হাসান জয়।

তরুণ বা উদীয়মান ক্রিকেটারদের আসরে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের পাঠিয়ে দেওয়ার অভ্যাস নতুন নয় বাংলাদেশে। ২০১৯ সালে বেঙ্গালুরুতে ডা. কে থিম্মাপ্পা স্মৃতি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা নামে একটি চারদিনের ম্যাচের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে অংশ নিয়েছিল কিছু ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, কিছু রাজ্য দলের দ্বিতীয় সারির দল। সেই আসরেই মমিনুল হক, তাইজুল ইসলাম, আবু জায়েদ রাহি, নাজমুল হোসেন শান্ত, সাইফ হাসান, এবাদত হোসেনসহ জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে বিসিবি একাদশ গড়ে খেলতে পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য আসন্ন ভারত সফরের আগে অভিজ্ঞতা অর্জন!

২০২২ সালেও জাতীয় লিগের মাঝখানে দেশে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে তামিলনাড়ু রাজ্য দলের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল যে বিসিবি একাদশ, সেই দলেও মোহাম্মদ মিঠুন, মমিনুল হক, সাদমান ইসলাম, নাঈম হাসান, তাইজুল ইসলামদের মতো টেস্ট দলের নিয়মিত খেলোয়াড়দের পাঠানো হয়।

চূড়ান্ত নির্লজ্জতা হিসেবে দেখা যেতে পারে ২০২৩ সালের ইমার্জিং এশিয়া কাপের দলে সৌম্য সরকারকে অন্তর্ভুক্ত করাটা। যে খেলোয়াড়ের অভিষেক ২০১৪ সালে, তখন পর্যন্ত খেলেছেন ২টা ওয়ানডে বিশ্বকাপ আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ (২০২৩ পর্যন্ত), সেই খেলোয়াড়কে নেওয়া হয়েছি উদীয়মান ক্রিকেটারদের টুর্নামেন্টে যেখানে অন্য দলগুলো পাঠিয়েছে মূলত বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারদের।

ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের একটা বড় অভিযোগ, বাংলাদেশের সবকিছু জাতীয় দল কেন্দ্রিক। অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা থেকে উন্নত কোচিং, ভালো উইকেট সবকিছুই যেন জাতীয় দলের জন্য বরাদ্দ আর বাকিরা ব্রাত্য। জাতীয় দলের অনুশীলন এবং পুনর্বাসনের জন্য পড়তি ফর্মে থাকা খেলোয়াড়দের পাঠানো হচ্ছে উদীয়মান দল বা জাতীয় দলের ঠিক নিচের স্তরে থাকা দলগুলোতে। ফলে অংশগ্রহণের সুযোগ কমছে তরুণ ক্রিকেটারদের। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যেভাবে প্রশাসনকে মাথাভারী করে তোলে, অনেকটা একই অবস্থা হচ্ছে ক্রিকেটেও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬-৭ বছর কাটিয়ে দিয়ে, ফের অনেক ক্রিকেটার এসে ভিড়ছেন উদীয়মানদের দলে!

অস্ট্রেলিয়া সফরের খেলোয়াড় তালিকা দেখে কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক ক্রিকেটার বলেই ফেললেন, ‘কয়েকজন ক্রিকেটারকেই যদি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব জায়গায় খেলান তাহলে তো দেশের ক্রিকেট আগাবে না।’

বিসিবির সাবেক কোচ এবং বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম এইচপি ইউনিটের প্রতিষ্ঠার সময়টা দেখেছেন কাছে থেকে।

দেশ রূপান্তরকে জানালেন এইচপির কাজের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যর সঙ্গে অমিল দেখছেন, ‘এইচপি গড়ার উদ্দেশ্য ছিল নিচের দিক থেকে প্লেয়ার পাম্প করে ওপরের দিকে তুলে আনা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেকদিন ধরে খেলেছে, কিংবা জাতীয় দলে পড়তি ফর্মে আছে এই ধরনের খেলোয়াড়দের জায়গা হওয়ার কথা ‘এ’ দলে। জাতীয় দলে খারাপ করলে তারা ‘এ’ দলে আসবে। ‘এ’ দলে এসে খারাপ করলে বুঝতে হবে তাদের দিয়ে হবে না, তারা সরে যাবে, অন্য কেউ আসবে। ডেভেলপমেন্ট মানেই হচ্ছে প্লেয়ার নিচে থেকে আস্তে আস্তে ওপরে উঠবে। কিš দেখতে পাচ্ছি বেশ কয়েকজন প্লেয়ার ওপর থেকে নিচে চলে যাচ্ছে। যারা অনেকদিন ধরে জাতীয় দলে খেলছে তারা আবার নিচে চলে আসছে। ফলে যেটা ঘটছে, নতুন যে খেলোয়াড়টা উঠে আসছে, তাদের জায়গাগুলো এরা নষ্ট করছে। ভবিষ্যৎ ক্রিকেটারদের জন্য যে সুযোগগুলো ছিল সেগুলো আর সেভাবে কাজে লাগছে না।’

সফরে এইচপির প্রতিপক্ষদের একটি বিগব্যাশ লিগের ফ্র্যাঞ্চাইজি মেলবোর্ন স্টাস- এর মহাব্যবস্থাপক ব্লেয়ার ক্রাউচ আয়োজক নর্দার্ন টেরিটোরি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়েছেন, ‘মেলবোর্ন স্টার্স অ্যাকাডেমি দল নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এই প্রতিযোগিতায় (টপএন্ড টি-টোয়েন্টি) অংশ নিতে পেরে আনন্দিত। এতে আমরা ভিক্টোরিয়া অঞ্চলের তরুণ টি-টোয়েন্টি প্রতিভাদের খুঁজে পাব এবং আমাদের অ্যাকাডেমিতে থাকা চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়রাও তাদের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পাবেন।’

আরেক প্রতিপক্ষ পার্থ স্কর্চার্স ফ্র্যাঞ্চাইজির মহাব্যবস্থাপক কেড হার্ভের বক্তব্য, ‘এটা অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া মৌসুম শুরুর আগে প্রাক-মৌসুম আয়োজন হিসেবে আমাদের প্রস্তুতির মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। এর মাধ্যমে আমরা ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার তরুণ কিছু ক্রিকেটারকে টুর্নামেন্টের ভেতর অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার কিছু শক্তিশালী দলের বিপক্ষে পরখ করার সুযোগ পাব।’

অর্থাৎ অংশগ্রহণকারী স্থানীয় দলগুলো মূলত ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর অ্যাকাডেমির খেলোয়াড়দের নিয়ে, সঙ্গে স্থানীয় কিছু ক্রিকেটার। তাদের বিপক্ষে খেলার জন্যই কি না রীতিমতো আটঘাট বেঁধে চার-পাঁচজন ক্রিকেটারকে এইচপি দলে ফিরিয়ে এনে দল সাজিয়েছেন নির্বাচকরা!

এ ব্যাপারে নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল দেশ রূপান্তর, উত্তর এসেছে, ‘এটা কি কোথাও লেখা আছে এইচপি এদের (সদ্য অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে উঠে আসা বা অনূর্ধ্ব-২৩ স্তর) জন্য?’