প্রচ্ছদ জাতীয় বিমানের টিকিট জালিয়াতি, জড়িত কর্মকর্তারাই

বিমানের টিকিট জালিয়াতি, জড়িত কর্মকর্তারাই

চলতি বছর মে মাসে ঢাকা থেকে শ্রমিকদের কুয়ালালামপুর পাঠাতে যে টিকিট সংকট ও জালিয়াতি হয়, তার তদন্ত প্রতিবেদনে ২০টি ট্রাভেল এজেন্সির নাম এসেছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের টিকিট জালিয়াতিতে জড়িত বিমানেরই বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তদবির বা কারসাজিতে বিমানের সাবেক এমডি, পরিচালক এমনকি তৎকালীন মন্ত্রীর নামও এসেছে।

কারসাজিতে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম, সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ও সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গেল মে মাসে বিমানের ৫টি ফ্লাইটে ২২০০ আসনের অর্ধেকই কারসাজি হয়েছে। আর খালি গেছে অর্ধশতাধিক আসন।

চলতি বছর মে মাসে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের নতুন শ্রমিক প্রবেশের শেষ সময় বেঁধে দেওয়া হলে ঢাকা থেকে বিমানের টিকিট সংকটে পড়েন ৫০ হাজার শ্রমিক। রিক্রুটিং আর ট্রাভেল এজেন্সির দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঢাকা-কুয়ালালামপুর ৩০ হাজার টাকার টিকিট দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকায় কিনতে হয়েছে অনেককে। টিকিট না পেয়ে নির্ধারিত সময়ে শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া যেতে পারেননি বহু শ্রমিক।

টিকিট নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। বিমান কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় এর তদন্ত করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানের অনলাইন সিস্টেমে টিকিট উন্মুক্ত করার আগেই একটি বড় অংশ ব্লক করে দেওয়া হয়। রুট অ্যানালিস্ট ফারহানা আক্তার ২৪ মের ফ্লাইটের জন্য রাত ২টা থেকে রাত ২টা ১২ পর্যন্ত ১২ মিনিটে ১০২টি আসন এ রকমভাবে ব্লক করেন। ২৯ মের ফ্লাইটের ১১৩টি টিকিট মাত্র ২২ মিনিটে ব্লক বা ওভার বুকিং করেন।

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২৭ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত তিন দিনে পরিচালিত বিমানের ফ্লাইটগুলোর মধ্যে ৫টি ফ্লাইটে ১১৪৬ আসনের টিকিট জালিয়াতি করা হয়েছে। ২৭ মের দুটি ফ্লাইটে ৩২৩টি, ২৮ মের একটি ফ্লাইটে ৫৮টি, ২৯ মের একটি ফ্লাইটে ৩৭৩টি এবং ৩০ মের একটি ফ্লাইটের ৩৯২টি টিকিট জালিয়াতি করে কিছু ট্রাভেল এজেন্সির কাছে বিক্রি করেন বিমানের লোকজন। এসব টিকিট কমদামে কিনে নেয় ২০টি এজেন্সি; আর যাত্রীদের কাছে বিক্রি করে কয়েকগুণ বেশি দামে। এই জালিয়াতির কারণে সংকটের মধ্যে অনেক আসন খালি গেছে।

তদন্তে এই জালিয়াতিতে বিমানের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের ওই সময়ের পরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিনসহ তার অধীনস্থ তিনকর্মী ফারহানা আক্তার, এফএম তাবিবুর রহমান ও গোলাম মোস্তফার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালে টিকিট কারসাজিতে অভিযুক্ত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

কারসাজির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- বিমানের কোনো ফ্লাইটের টিকিট অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্সি, বিমানের ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ ও সকল সেলস কাউন্টার থেকে একসঙ্গে দেখা ও বুকিংয়ের সুবিধা থাকার কথা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের পোস্ট এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে টিকিট কিনতে গেলে সোল্ড আউট দেখা যায়। বেশির ভাগ এজেন্ট তাদের কাছে টিকিট নেই বলে জানিয়ে দেয়। তবে অল্প কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্ট চড়া দামে টিকিট বিক্রির প্রস্তাব দেয়। এভাবে টিকিট কিনে ফ্লাইটে ওঠার পর যাত্রীরা অনেক আসন খালি দেখতে পান।

তদন্তে দেখা গেছে, টিকিট সিস্টেমে উন্মুক্ত করার আগেই টিকিটের একটি বড় অংশ ব্লক করে ফেলা হচ্ছে। রুট অ্যানালিস্টরা ওভারবুকিং করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক টিকিট সিস্টেমের বাইরে নিয়ে আসছেন। গুটিকয়েক এজেন্সির মাধ্যমে বেশির ভাগ টিকিট বিক্রি হতে দেখা যায়। ওভারবুকিং করে বিমানের অসাধু কর্মকর্তারা এটি না করলে সমস্যার সৃষ্টি হতো না। স্বাভাবিক নিয়মে লোয়ার ‘আরভিডি’তে টিকিট বিক্রি শুরুর পর ওই ক্লাসটিতে সব টিকিট বিক্রির পর হাইয়ার ‘আরবিডি’তে বিক্রির কথা। কিন্তু ঢাকা-কুয়ালালামপুরগামী ফ্লাইটগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র ছিল। এতে প্রতীয়মান টিকিট বিক্রির শেষ পর্যায়ে আগ্রহী যাত্রীদের লোয়ার আরবিডিতে ওভারবুকিং করে টিকিট ইস্যু করা হয়। এতে করে কাগজকলমে বিমান ওই যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ভাড়া গ্রহণ করলেও বাস্তবে ট্রাভেল এজেন্সি ও বিমানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ওই যাত্রীদের কাছ থেকে চড়া মূল্য আদায় করা হয়েছে। এরকম যাত্রীদের কাছ থেকে হাইয়েস্ট আরবিডিতে টিকিট ইস্যু না করায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিমান।

ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে চলতি বছর মে মাসের শেষ সময়ে বিজনেস ক্লাসের ভাড়া ট্যাক্সসহ ছিল ১ লাখ ৫১ হাজার ৯১৫ টাকা। ৩০ মে তারিখের ফ্লাইট ছাড়া অন্যান্য দিন বিজনেস ক্লাসে কোনো যাত্রী ছিল না। ইকোনোমি ক্লাসে বিভিন্ন আরবিডিতে ভাড়া ৫১ হাজার ৮১৩ টাকা থেকে ৭৮ হাজার ১১ টাকা পর্যন্ত ছিল। অথচ ৩১ মের আগে মালয়েশিয়া পৌঁছার টার্গেট নিয়ে যারা এ রুটে টিকিট কেনেন, তারা ট্রাভেল এজেন্সিকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি মূল্য পরিশোধ করেছেন। যাত্রীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অসাধু কর্মকর্তারা টিকিট ব্লক বা ওভারবুকিং করে সাধারণত চ্যানেলগুলোতে তা দুষ্প্রাপ্য করে তুলেছেন এবং কিছু ট্রাভেল এজেন্সির যোগসাজশে যাত্রীদের কাছে তা চড়া মূল্যে বিক্রির সুযোগ তৈরি করেছেন। চড়া দামে টিকিট বিক্রির অভিযোগ তদন্তে পরিচালক সালাহউদ্দিন কোনো উদ্যোগ নেননি বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তদন্তকালে কমিটির কাছে এক পাতার স্ল্যাপশট আসে। এতে বিমানের এমডি শফিউল আজিম এবং মন্ত্রী ফারুক খানের রেফারেন্সে ৯১টি টিকিট ইস্যু করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. সাফিকুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আটাবের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ আমাদের সময়কে বলেন, তখন বিমানের টিকিট নিয়ে ভয়াবহ সংকট ছিল। একপর্যায়ে বিমান এক্সট্রা ফ্লাইট দিয়েছিল। কিন্তু যে সময় দিয়েছিল বিমান তখন কম্পিউটারের সামনে বসেও আমরা টিকিট পাইনি। কিছু এজেন্সি টিকিট পেয়েছে। বাকিরা ছিল বঞ্চিত। এখানে অনিয়ম ছিল। তখন মনে হয়েছে এটা বৈষম্য। অতিরিক্ত দামে কিছু এজেন্সি টিকিট বিক্রি করে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ে আমরা অভিযোগ করেছিলাম।

গত ২১ মার্চ মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছিল, বিদেশি কর্মীদের জন্য ৩১ মে বন্ধ হয়ে যাবে দেশটির শ্রমবাজার। ৭০ দিন আগে জেনেও ভিসা পাওয়া সব কর্মীকে নির্ধারিত সময়ে পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ। ফ্লাইট সংকটে শেষ দুই সপ্তাহে ঢাকা-কুয়ালালামপুরের বিমান ভাড়া ২৫ হাজার থেকে বেড়ে লাখ টাকার বেশি হয়। মালয়েশিয়া থেকে আসা ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৩ চাহিদাপত্রের বিপরীতে গত ৩১ মে পর্যন্ত জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ছাড়পত্র দেয়। তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়া গেছেন। ১৬ হাজার ৯৭০ কর্মী যেতে পারেননি। জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বায়রার হিসাবে, এই কর্মীদের মধ্যে ৫ হাজার ৯৫৩ জন শুধু উড়োজাহাজের টিকিট না পাওয়ায় যেতে পারেননি। বাকি ১১ হাজার যেতে পারেননি বিভিন্ন কারণে।

সুূুত্রঃ আমাদের সময়

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।