রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন মার্কেটগুলোতে অবৈধ পন্থায় দোকান বরাদ্দসহ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে আফজালচক্র। আওয়ামী লীগের দেড় দশকে নিয়মবহির্ভূতভাবে শত শত দোকান বরাদ্দ, পার্কিংয়ের জায়গায় অবৈধ দোকান, অবৈধ মালিকদের বৈধতা দেওয়া ও চাঁদাবাজিসহ নানাভাবে হাতিয়ে নিয়েছে এসব অর্থ। এক বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে দুইশ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছে আফজালচক্র। ঢাকা ট্রেড সেন্টারের ১৯৩টি দোকান বরাদ্দেও জালিয়াতি করে একশ কোটি টাকার বেশি নিজেদের পকেটে পুড়েছে এই চক্র।
এদিকে হাসিনা সরকারের সময় ভুক্তভোগীরা ভয়ে নিশ্চুপ থাকলেও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে দোকান বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও কিশোরগঞ্জের সাবেক এমপি আফজালসহ চক্রের ১৮ জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন এক ব্যবসায়ী। গত ২২ নভেম্বর মামলার পর ২০ দিনের বেশি পেরিয়ে গেলেও আসামিদের কেউ ধরা পড়েনি। তবে মামলা তদন্তকালে আসামিদের অনেকের আত্মগোপন ও পলাতক থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। আবার কেউ কেউ একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আঁতাত করে কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে। খুব শিগগির আত্মগোপনে থাকা আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তর এবং ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ নামের মার্কেট দুটি এক সময় গুলিস্তান হকার্স মার্কেট ও বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট নামে পরিচিত ছিল। একই ভবনে দুই নামে পরিচিত মার্কেট দুটির ৫ম তলার ৩ শতাধিক দোকানের মধ্যে ১৯৩টি দোকান বরাদ্দে জালিয়াতি করে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আফজালচক্র। কাগজপত্র জালিয়াতি করে ভুয়া ছবি ও পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তরের ১৪৪টি ও ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণে ৪৯টি দোকানসহ মোট ১৯৩টি দোকান বরাদ্দ দিয়ে এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটির মালিকানাধীন সব মার্কেটে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, ব্যারিস্টার তাপস ও এমপি আফজাল গং। চক্রের সদস্যরা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও ঢাকা ট্রেড সেন্টারে নকশাবহির্ভূতভাবে শত শত দোকান বানিয়ে বিক্রি করেছেন। মূলত এই প্রভাবশালীদের সামনে রেখে মাঠের অনিয়ম-দুর্নীতি বাস্তবায়ন করেছেন দেলোয়ার হোসেন দেলু, নাজমুল হুদা, মোজাম্মেল হক মজু, হুমায়ুন কবির মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম সিন্ডিকেট। তাদের সবাই আওয়ামী লীগ আমলে মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে ছিলেন। ৫ আগস্টের পর গংয়ের সদস্যরা অনেকেই আত্মগোপন ও পলায়ন করলেও অবৈধ পন্থায় তৈরি ও বরাদ্দ দেওয়া দোকানগুলো এখনো বহাল তবিয়তে আছে দখলদারদের অনুকূলে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নথি থেকে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকার ১০টি মার্কেট বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে দক্ষিণ সিটির কাছে দোকান মালিকদের তালিকাসহ হস্তান্তর করা হয়। তালিকায় শুধু দোকান মালিকদের নাম ও পিতার নাম থাকলেও কোনো ছবি বা ঠিকানা ছিল না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণের ৬৩৭ জনের তালিকায় ৪৯টি এবং উত্তরের ৬০৮ জনের তালিকায় ১৪৬টি নাম নতুন করে যুক্ত করে ডিএসসিসিতে পাঠায়। অথচ নতুন যুক্ত করা কারোর নামেই মার্কেটে দোকান ছিল না। বিষয়টি জানার পর প্রকৃত দোকান মালিকরা ভুয়া নম্বর বাতিলের জন্য সিটি করপোরেশন ও তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে (বর্তমানে দুদক) অভিযোগ করে। পরে এই ভুয়া নম্বরের হোতাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করে ব্যুরো। এছাড়া ওইসব দোকান নম্বরের বিপরীতে সিটি করপোরেশনকে টাকা জমা নিতে নিষেধ করা হয়। কেউ কেউ প্রথম ধাপের টাকা পরিশোধ করলেও দুর্নীতি দমন ব্যুরোর নির্দেশনার পর টাকা জমা নেওয়া বন্ধ করে দেয় করপোরেশন। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৯৩ দোকানের কথিত মালিকরা পরে আর টাকা জমা দিতে করপোরেশনে যাননি।
এদিকে ২০০৭ সালে প্রকৃত মালিকদের লটারির মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হলে ওই ১৯৩ জনের নামে কোনো দোকান বরাদ্দ হয়নি। এর মধ্যে রহস্যজনক কারণে ২০১২ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মামলাটিতে কাউকে অভিযুক্ত না করে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয় বর্তমান দুদক। পরে আফজালের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার যোগসাজশে জোটবদ্ধ হয়। তারা ট্রেড সেন্টার উত্তরের ১৪৪টি দোকানের মধ্যে ১২০-১২৫টির কাগজপত্র জালিয়াতি করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে বিক্রি করে। প্রতিটি দোকান বাবদ ৭০-৮০ লাখ টাকা করে নেয়। তবে ওই ১৪৪ জনের মধ্যে ২০-২৫ জন প্রকৃত মালিক দাবি করে সিটি করপোরেশনে টাকা জমা দিয়ে ৫ তলায় দোকান বরাদ্দ পান। অপর দফায় ট্রেড সেন্টার দক্ষিণের ৪৯ জনের নামেও দোকান নেওয়া হয়। পরে বাকি ১১৯ জন দোকান মালিকের ছবি, ঠিকানা ও ভুয়া আইডি কার্ড বানিয়ে টাকা জমা দিয়ে সেসব দোকানও বরাদ্দ নেয় চক্রটি। পরবর্তী সময়ে ব্যারিস্টার তাপস মেয়র নির্বাচিত হলে তার নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা নিজেদের কর্তৃত্ব বহাল রাখে। গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর অনিয়মে জড়িত প্রায় সবাই লাপাত্তা হয়ে গেলেও একটি দলের নাম ভাঙিয়ে মোজাম্মেল হক মজুসহ আরও কয়েকজন এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অবৈধ ১৪৪টি দোকানের মালিক মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো সঠিক বলে সমিতির প্যাডে সার্টিফিকেট দেন ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক! এতে সিন্ডিকেটের পকেটে যায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। মূলত সিন্ডিকেটের সদস্যরা বেনামে এসব দোকান বরাদ্দ নিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন। দেশের পটপরিবর্তনের পর আগের কমিটির নেতারা পলায়ন করলে অস্থির পরিস্থিতিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠিত হয়।
ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ দোকান মালিক সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন রানা বলেন, একটি অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি দায়িত্ব নিয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে নির্বাচিত সরকার কথা বলবে। তবে নাম প্রকাশ না করে বর্তমান কমিটির কয়েকজন জানান, নামে-বেনামে দোকান বরাদ্দ দিয়ে কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করেও পার্কিং ও টয়লেটের জায়গায় দোকান তৈরি করে সেগুলো ৭০-৮০ লাখ টাকা করে বিক্রি করেছে।
আফজলচক্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী কামাল হোসেন রিপন বলেন, তাপস-আফজাল গংয়ের বিরুদ্ধে অতীতে আন্দোলন করে কোনো কাজ হয়নি। হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ২২ নভেম্বর শাহবাগ থানায় আমি একটি মামলা করেছি। মামলায় তাপস ও আফজালসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে ২০-২২ জনকে আজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। তবে মামলার পর ২০ দিনের বেশি পেরিয়ে গেলেও কেউ গ্রেফতার হয়নি। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত তৈরি ৫৯১টি দোকান বরাদ্দ দিয়ে ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ বহুতল ভবন নির্মাণের অজুহাতে আগুন দিয়ে মার্কেট পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে আফজাল হোসেন ও ব্যারিস্টার তাপসের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। ৫ আগস্টের পর তারা মোবাইল বন্ধ করে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
মামলার অগ্রগতি নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই মাইনুল ইসলাম খান পলক বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর আসামিদের অনেকে পালিয়ে গেছেন, কেউ দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে দেশে আত্মগোপনে থাকা আসামিদের ধরতে চেষ্টা চলছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব শিগগির তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |