বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতীয় নাগরিক কমিটির আয়োজনে একটি বিজয় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। তা বাংলামোটর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে যায়। এতে ঢাকার বিভিন্ন থানা ও দেশের অন্যান্য জেলা থেকে লোকজন অংশ নেন। নাগরিক কমিটি দাবি করছে- তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হবে এবং আগামী দু’মাসের মধ্যে দলটির কাঠামো স্পষ্ট হবে। তবে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং নতুন দলের প্রস্তুতির বিষয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে- বিশেষ করে দলটির নেতৃত্ব ও নীতি-আদর্শ সম্পর্কে।
সম্ভাব্য দলের শীর্ষ নেতাই বা কে হবেন সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির ধারার বাইরে নতুন দলের চাহিদা তৈরি হয়েছে মনে করছে নাগরিক কমিটি। সংগঠনের নেতারা আশাবাদী তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বড় রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের ব্যাপারে যেখানে মূল ভূমিকায় থাকবে তারা। পাশাপাশি সেই দলে ভূমিকা থাকবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও।
ফেব্রুয়ারির মধ্যেই দলের আত্মপ্রকাশ সম্ভব?
জাতীয় নাগিরিক কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা যাচ্ছে, শুরুতে ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্য ছিল। তবে নানা জটিলতায় সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নতুন করে দল গঠনের সম্ভাব্য সময়সীমা ধরা হয়েছে ফেব্রুয়ারি।
দলটির নেতারাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘দুয়েক মাসের মধ্যেই’ রাজনৈতিক দল আসবে এমন বক্তব্য দিয়েছেন।
কিন্তু দল গঠনের কাজ ঠিক কতটা এগিয়েছে এমন প্রশ্নে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইতোমধ্যেই তারা সারা দেশে প্রায় শ’খানেক জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করছি ডিসেম্বরের মধ্যেই আমাদের সম্ভাব্য সকল কমিটি দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে যাবে। এরপরের ধাপে যখন আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ছড়িয়ে পড়ব, তখন আমাদের রাজনৈতিক দল গঠনের যে প্রক্রিয়া আমরা সেটার মুখোমুখি এসে দাঁড়াব বলে মনে করছি।’
তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে আমাদের মাঠের নানা কর্মসূচি চলতে থাকবে। যার মাধ্যমে সাংগঠনিক প্রক্রিয়াকে মজবুত করার কাজটা চলছে। আমরা এখনো সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ বলতে চাই না। তবে মনে করছি সব মিলিয়ে আমরা এক-দুই মাসের মধ্যেই একটা রাজনৈতিক দল দেখতে পাব।’
বাংলাদেশে গত অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকেই ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হচ্ছে– এমন একটা আলোচনা ব্যাপকতা পায়। অভ্যুত্থানের এক মাস পর সেপ্টেম্বরে আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বলে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠন করে সংগঠনের বিস্তৃতিও ঘটিয়েছে তারা। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তৃণমূলে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হলে দলও দাঁড়িয়ে যাবে।
কিন্তু তৃণমূলে সংগঠনের বিস্তৃতি কতটা হচ্ছে? সেটা বুঝতে আমরা কথা বলি নারায়ণগঞ্জ শহরে সদ্য গঠিত নাগরিক কমিটির একজন নেতার সঙ্গে।
নারায়ণগঞ্জ সদরে নাগরিক কমিটির প্রতিনিধি মো. শওকত আলী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, থানা কমিটি গঠনের পর তাদের এখন লক্ষ্য পাড়া-মহল্লাভিত্তিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করা।
তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের সাতটি থানায় আমাদের কমিটি হয়ে গেছে। এখন এই সাত থানাকে সমন্বয় করে আমরা একটা সাংগঠনিক টিম গঠন করছি। এটার মাধ্যমে আমরা জেলা বা মহানগর কমিটি তৈরি করব। তারপর মহানগরের অধীনে যতগুলো ওয়ার্ড আছে, প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি করবো। এরপর গ্রামভিত্তিক কমিটি হবে।’
আলী বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করা। নাগরিক কমিটি নিজে দল হবে না। কিন্তু আমাদের ভেতর থেকেই দলটা তৈরি হবে আলাদা নামে। আমাদের কাজ হবে পাড়া-মহল্লায় প্রান্তিক মানুষের কাছে সেই দলের খবর পৌঁছানো, দলটাকে পরিচিত করে তোলা, রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করা।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা আশাবাদী তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বড় রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের ব্যাপারে যেখানে মূল ভূমিকায় থাকবে তারা। পাশাপাশি সেই দলে ভূমিকা থাকবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও।
যদিও নাগরিক কমিটি কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনোটিই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হবে না। বরং স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবেই থেকে যাবে।
এই দুটি সংগঠন থেকে যারা রাজনীতিতে অংশ নিতে ইচ্ছুক তারা নতুন দলে যোগ দেবে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় গত প্রায় চার দশকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো সারা দেশে বিস্তৃত বড় কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও সেগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দলে রূপান্তরিত হতে পারেনি।
এছাড়া বাম-ডান, জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে ইসলামপন্থি আদর্শের রাজনীতিও আগে থেকেই উপস্থিত আছে দেশটিতে।
ফলে ছাত্রদের নতুন দল কোন আদর্শকে সামনে রেখে এগোবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
একইসঙ্গে দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতা কারা হবে সেটা নিয়েও আলোচনা আছে।
যদিও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলছেন, শীর্ষ নেতা কে বা কারা হবেন সেটা এখনও তারা ঠিক করেননি।
আখতার হোসেন বলেন, প্রধান নেতা কে হবেন সেটা আমরা নির্ধারণ করিনি। আমরা চাচ্ছি যে আগে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ঠিক হোক। আমাদের আদর্শের জায়গাটি কী হবে, নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলী কার মধ্যে কেমন, কারা সাংগঠনিকভাবে ভালো এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সেগুলো বিবেচনা করেই আলোচনার ভিত্তিতে নেতৃত্ব ঠিক হবে।
অন্যদিকে সংগঠনটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, বাংলাদেশে একক শীর্ষ নেতার যে ধারণা সেখান থেকেই বেরিয়ে আসতে চান তারা। এক নেতার এক দল– সেরকম কোনো কাঠামোতে আমরা যাবো না এটা নিশ্চিত। আমাদের দলে যৌথ নেতৃত্বের ধারণা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
বাংলাদেশে যেভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সারা দেশে বিস্তৃত এবং ভোটাররাও প্রধানত এই দুই পক্ষে বিভক্ত সেখানে নতুন দল কতটা সুবিধা করতে পারবে সেটা এখনও নিশ্চিত নয়।
তবে জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে বা তাদের ভাষায়, সাধারণ মানুষ নতুন দলের অপেক্ষায় আছে।
আখতার হোসেন বলেন, আমরা একটা মধ্যমপন্থি রাজনীতির কথা বলছি। এটাই আমাদের আদর্শ হবে। আমরা বাম-ডান এমন যে বিভাজন আছে সেগুলোতে ঢুকতে চাই না। আমরা বাংলাদেশ প্রশ্নে এক থাকতে চাই। ইসলাম ফোবিয়ার রাজনীতি অথবা উগ্র ইসলামপন্থি বা উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মধ্যেও আমরা নেই।
হোসেন বলেন, আমরা জনগণের কাছে গিয়ে যে ধারণা পেয়েছি এবং বিভিন্ন জরিপেও দেখবেন একটা নতুন দলের আকঙ্ক্ষা আছে জনগণের মধ্যে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। তাদেরকে মানুষ দেখেছে। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে জনগণের একটা বিশাল অংশ আছে, যারা নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব দেখতে চায়। সে জায়গা থেকে আমরা মনে করি আমাদের দল গঠিত হলে সেটা জনসমর্থন পাবে। ধীরে ধীরে আমরা একটা বড় দল হতে পারব।
নাগরিক কমিটি মনে করছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপির ধারার বাইরে নতুন দলের চাহিদা তৈরি হয়েছে। কিন্তু যেভাবে ছাত্রদের একটা অংশ সরকারে থাকা অবস্থায় তাদেরই আরেকটি অংশ বাইরে থেকে দল গঠনের চেষ্টা করছেন, রাজনীতিতে সেটাকে ‘সরকারি আনুকূল্যে দল গঠনের চেষ্টা’ হিসেবেও ব্যাখ্যা করছেন কেউ কেউ।
এছাড়া সম্ভাব্য নতুন দলটিকে গুছিয়ে ওঠার সুযোগ দিতে নির্বাচনে বিলম্ব করা হচ্ছে কি না এমন আলোচনাও আছে রাজনৈতিক মহলে।
জানতে চাইলে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন জানিয়েছেন, তাদের দল অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নেবে।
কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলের লক্ষ্য কী থাকবে এমন প্রশ্নে আখতার হোসেন বলছেন, এখনই ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন তারা দেখছেন না।
তিনি বলেন, একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান টার্গেট থাকে সরকার গঠন করার। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে তরুণদের প্রতি মানুষের যে আস্থার জায়গা আছে সেটাকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে বাংলাদেশে যে নতুন রাজনৈতিক দলটি গঠিত হবে, তারা এবার হোক বা পরেরবার হোক। ক্ষমতা পরিচালনার মানসিকতা নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হবে, যাতে করে অন্ততপক্ষে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় যেন আমরা থাকতে পারি, সে টার্গেট আমাদের আছে।
হোসেন বড় লক্ষ্যের কথা বললেও সমস্যা হচ্ছে, অতীতে এমন অনেক রাজনৈতিক উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সেভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি।
তবে ছাত্র নেতারা মনে করছেন, এবার অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি তাদেরকে এগিয়ে দেবে।
ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়ার পর মানুষের মধ্যেও আগ্রহ থাকবে তরুণদের নিয়ে।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |