প্রচ্ছদ হেড লাইন নাতিকে হারালাম, ছেলেটাও মৃত্যুপথযাত্রী

নাতিকে হারালাম, ছেলেটাও মৃত্যুপথযাত্রী

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৯টা। কেবল রাতের খাবার খেয়ে উঠেছি। এর মধ্যে ছেলের নম্বর থেকে অপরিচিত এক লোকের ফোন। বললেন, এ নম্বর কার? যে ব্যক্তির এ নম্বর তিনি এক্সিডেন্ট করে গুরুতর অবস্থায় আছেন। দ্রুত কুর্মিটোলা হাসপাতালে আসেন। আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল। তাড়াতাড়ি বাড়ির মালিককে জানিয়ে বের হলাম। দেখলাম আমার ছেলে সুমনের শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্ত বের হচ্ছে সারা শরীর থেকে। ওর একপাশের মাংস আরেকপাশে চলে গেছে।’

‘ডাক্তাররা বলছেন দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। এদিকে খোঁজ নিয়ে শুনি আমার নাতি (সুমনের ছেলে) এই এক্সিডেন্টে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাব নাকি নাতির লাশ আনব; আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি তো পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন গতকাল রাজধানীর খিলক্ষেত ফুটওভার ব্রিজের নিচে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নিহত শিশু ইয়াসিনের দাদা মফিজ মিয়া। এ ঘটনায় আমরিনা হক (২৭) নামে এক নারী ও উজ্জ্বল পান্ডে (২৬) নামে এক পুরুষও নিহত হন। গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ১০১ নং ওয়ার্ডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন নিহত ইয়াসিনের বাবা সুমন মিয়া।

বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সুমনের বাবা মফিজ মিয়া ও ছোট ভাই সুজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের।

৮ বছর বয়সী নিহত ইয়াসিন মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। ইয়াসিনের বাবা সুমন মিয়া রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।

মফিজ মিয়া পেশায় নিরাপত্তাকর্মী। নিকুঞ্জের ১৩ নং রোডের ৪১ নং বাসায় কাজ করেন তিনি। ঢাকা পোস্টকে মফিজ মিয়া বলেন, ‘মোহাম্মাদপুর থেকে আমার ছেলে আর নাতি আমাকে দেখতে খিলক্ষেতে এসেছিল। আসার সময় ভুনা খিচুড়ি আর শীতের পিঠা নিয়ে আসে। আমি সেসব খাবার রেখে তাদের সঙ্গে গল্প করি। সে সময় আমার নাতি ইয়াসিন বলেছিল দাদা আমার ক্ষুধা লাগছে। আমি ওরে (ইয়াসিনকে) একটা চিপস আর পাঁচটি জুস কিনে দিয়েছিলাম। চিপসটা এখানে বসেই খেয়েছে। কিন্তু জুস বাসায় গিয়ে খাবে বলে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।জুস ও খুব পছন্দ করত। ইয়াসিনের আর সেই জুস খাওয়া হলো না। সেই জুস পড়ে আছে; শুধু ইয়াসিন নেই।’

মফিজ মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে আর নাতি বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমি খেতে বসি। খাবার শেষে যখন উঠব তখন কল, খবর পাই দুর্ঘটনার। আমি যে বাসায় চাকরি করি সেই বাসার মালিককে জানিয়ে দ্রুত বের হয়ে পড়ি। হাসপাতালে এসে ছেলেকে পেলাম ঠিকই কিন্তু নাতিকে পেলাম না!’

‘কুর্মিটোলা থেকে ছেলেকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া লাগবে। এর কিছুক্ষণ পর শুনলাম আমার নাতি আর নেই। ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ছেলেকে ঢাকা মেডিকেলে নেব নাকি নাতির লাশ নেব আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’

‘পরে লোক পাঠিয়ে দিলাম নতির লাশ আনতে। শুনলাম সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। তারা লাশের কাছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গেলো।এদিকে আমি সারারাত আমার ছেলের পাশে ঢাকা মেডিকেলে কাটিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল সিট পাইনি। ফ্লোরেই চিকিৎসা চলছে। একদিকে রক্ত দিচ্ছে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি ডাক্তারকে বললাম স্যার আপনারা ব্লাড বন্ধ করেন। তারা বলে আপনারা রোগীকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান। এটা করেন-ওটা করেন।নাতি তো দুনিয়া থেকে চলে গেছে। এখন ছেলেকে বাঁচাতে পারি কিনা শেষ চেষ্টা করছি! শেষ যখন নাতির সঙ্গে কথা হয় তখন সে বলেছিল দাদু আমার ক্ষুধা লাগছে। ওর কথাটা কানে বাজছে।’

মফিজ মিয়া বলেন, ‘আমার নাতির মামা বাড়ি বরিশালে আর দাদা বাড়ি নোয়াখালীতে। তার লাশ কোথায় দাফন করা হবে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেকেই বলছেন, বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করার জন্য। সেখানেই দাফন করব ভাবছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার নাতিকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, ছেলের জীবনকেও কেড়ে নিচ্ছে আমি তাদের বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই। এ দেশের সাধারণ মানুষ কোন বিচার পায় না। বড়লোকের টাকা আর ক্ষমতার কাছে মানুষ জিম্মি। আমার তো টাকা নেই ক্ষমতাও নেই। গরিবকে মেরেই শক্তিশালীরা পার পেয়ে যায়!’

‘আমার ছেলের অবস্থাও খুব খারাপ। দুই হাত ভেঙে গেছে। তার এক দিকের মাংস অন্যদিকে চলে গেছে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। কোমরেও আঘাত। রোগীকে দেখার পরে ডাক্তাররা শুধু বলে ব্লাড লাগবে ব্লাড লাগবে। আমার ছেলের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। সারারাত মানুষকে ফোন দিয়ে ব্লাড খুঁজেছি। পরে সাড়ে চার হাজার টাকা করে ৯ হাজার টাকা দিয়ে দুই ব্যাগ ব্লাড কিনেছি। একদিক দিয়ে ব্লাড দিচ্ছে আরেক আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।আমি বেতন পেয়েছি ১০ হাজার টাকা। দুই ব্যাগ ব্লাডেই শেষ হয়ে গেল ৯ হাজার। তাইলে আমার লাভ কী লাভ হলো?

তিনি বলেন, ‘আমার এক ভাতিজা উকিল। সে আসছিল দেখতে। তাকে আমি বললাম ব্লাড কিনে আনছি আর সব একদিক দিয়ে বের হচ্ছে যাচ্ছে। তুই তাদের ব্লাড বন্ধ করতে বল। পরে সে ডাক্তারদের বললে ডাক্তাররা দেখেশুনে ব্লাড বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আবার সকাল থেকেই রক্ত এনে দিতে বলছে। কোথায় পাব এতো রক্ত?’

সুমনের বাসার পাশের মুদি দোকানদার শাহেদ হোসেন এসেছেন তাকে দেখতে। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাটা (নিহত ইয়াসিন) আমার দোকানে প্রায়ই যেত। গতকাল সন্ধ্যায় মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও আমার সঙ্গে কথা বলছে। আমার দোকানে গেছে। মাদ্রাসা ছুটি তাই বাবার সঙ্গে বাড়ি যাবে বলেছিল।’

টঙ্গী বাজারে ছোট ব্যবসা করেন নিহত ইয়াসিনের ছোট চাচা সুজন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনেই ঢাকা মেডিকেলে আসলাম। এসেই এক ব্যাগ রক্ত কিনলাম। ভাই তো ভাই-ই। কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে। দেখাতে পারছি না।রাত ৮ টায় ওরা আমার আব্বাকে দেখে বের হইছিল। আর ৯ টায় আমার ভাতিজা নেই। আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে ইয়াসিন। সে আজ নেই।’

সুজন বলেন, আমি ছোট চাচা। ইয়াসিনকে অনেক আদর করতাম। ইয়াসিনও আমাকেও খুব ভালোবাসত। ফোন দিলেই কাকু কাকু করে চিল্লাত। এখন আর কেউ চিল্লাবে না।’

উল্লেখ্য, বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাত ৯টার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেত ফুটওভার ব্রিজের নিচে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নারী-শিশুসহ তিনজন নিহত হন।

খিলক্ষেত থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোশারফ বলেন, রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দরের দিক থেকে আসা একটি বেপরোয়া প্রাডো জিপ গাড়ি ( ঢাকা মেট্রো-১৫-২৫৯১) ফুটওভার ব্রিজের নিচের আইল্যান্ডের সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীদের ওপর উঠে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই আট বছরের শিশু ইয়াসিন মারা যায়।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।