
দেশজুড়ে : সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের (ডিআইপি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) সেলিনা বানুর বিরুদ্ধে ৭ দিনে সাড়ে ৭ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়- মহাপরিচালকের (ডিজি) অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ৫০০ মাল্টিপল পাসপোর্টের আবেদন অনুমোদনের বিনিময়ে মাত্র ৭ দিনে সাড়ে ৭ কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেন। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বকালে একদিনেই তিনি মাল্টিপল পাসপোর্টের ৫০০ ফাইল ছাড় করেন। নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা প্রতিটি ফাইল অনুমোদনের জন্য তিনি দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের এনফোর্সমেন্ট টিম সেলিনা বানুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অধিদফতরের একজন কর্মকর্তার নাম প্রকাশ না করে তার উদ্ধৃতি দিয়ে ঐ প্রতিবেদনে বলা হয় যে পাসপোর্ট অধিদফতরে এ ধরনের অন্তত ১২ হাজার আবেদন তদন্তের জন্য জমা পড়ে আছে। এসব আবেদন যাচাই করে পুলিশের বিশেষ শাখার তদন্ত প্রতিবেদন ইতিবাচক হলে আবেদনকারীর বিপরীতে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগ থেকে সে ধরনের নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু সেই নির্দেশনা অমান্য করে প্রশাসন বিভাগের দায়িত্বে থাকা এডিজি সেলিনা বানু অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিপত্র জারি করে আটকে থাকা মাল্টিপল পাসপোর্টের আবেদনের বিষয়ে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নিজের ক্ষমতাবলে টাকার বিনিময়ে পছন্দমতো ফাইল ছাড় করেন।
রিপোর্টে বলা হয়- বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকা মাল্টিপল পাসপোর্টের হাজার হাজার ফাইলের মধ্যে ৫০০ ফাইল অনুমোদন দেওয়া নিয়ে খোদ অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেলিনা বানু প্রভাবশালী কর্মকর্তা হওয়ায় তার বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না তার রোষানলে পড়ার ভয়ে। রিপোর্টে আরো বলা হয়- শুধু মাল্টিপল পাসপোর্টই নয়, সেলিনা বানু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি পাসপোর্টধারীদের ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড (এনভিআর)’ সিল দেওয়ার জন্যও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিটি পাসপোর্টের এনভিআর দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা করে নিচ্ছেন।
মিডিয়ার অনুসন্ধানে যা জানা গেছে:
ঐ গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে সেলিনা বানুকে দুর্নীতি দমন কমিশনের এনফোর্সমেন্ট টিম জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে দাবি করা হলেও অনুসন্ধানে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে অনিয়ম, দালাল দৌরাত্ম্য ও গ্রাহকদের হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম তদন্ত করে। সেই সময় অনিয়মে জড়িত তিনজন আনসার সদস্য ও দালালকে হাতেনাতে আটক করা হয়। তবে অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানুর দুর্নীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো চিঠি দুদকে আসেনি। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। পরবর্তীতে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।
এডিজি সেলিনা বানুর বিরুদ্ধে ঐ রিপোর্ট প্রকাশের পর ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের কিছু শাখায় চলছে নানা আলোচনা। সরেজমিন অনুসন্ধানের সময়ে বিষয়টি নিয়ে অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এডিজি সেলিনা বানু দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে অধিদফতরের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ঐ রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সব অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি এই পদে আসার পর আগের থেকে আরো স্বচ্ছতার সঙ্গে সব কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সেলিনা বানু এডিজি হয়ে আসার পর অনেকেই অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা নিতে পারছেন না। অভ্যন্তরীণ তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। এসব কারণে তারা সেলিনা বানুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে থাকতে পারেন।
লিখিত বিবৃতিতে যা বলেছেন সেলিনা বানু:
এ বিষয়ে লিখিত বিবৃতিতে তিনি বলেন, মাল্টিপল পাসপোর্টের আবেদন অনুমোদনের যে তথ্য ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অসত্য, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। প্রতিদিন এ ধরনের আবেদন কী পরিমাণ অনুমোদন করা হবে তা নির্দিষ্ট করা থাকে। এছাড়া সহকারী পরিচালক থেকে মহাপরিচালক পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমোদন নিতে হয়। প্রতিবেদনে মাল্টিপল পাসপোর্টের আবেদন অনুমোদনের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তা অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত। প্রকৃতপক্ষে, এ সংখ্যা অনেক কম। এছাড়া প্রতিটি ফাইলের বিনিময়ে যে আর্থিক লেনদেনের (দেড় লাখ টাকা) কথা বলা হয়েছে, তাও হাস্যকর। টাকাগুলো কার মাধ্যমে, কোন উপায়ে নেয়া হয়েছে বা কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে সেসব তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি এভাবে কোনো কোনো পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে বা কারা ঘুষ দিয়েছেন সেই তথ্যও দেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এনভিআর সিল দেওয়ার বিনিময়ে টাকা নেয়ার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিমও কখনো আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি।
এডিজি সেলিনা বানু বলেন, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হচ্ছেন মহাপরিচালক (ডিজি)। কিন্তু ঐ প্রতিবেদনে আমাকে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ধারণাভিত্তিক। যে বেনামি চিঠির কথা বলা হয়েছে তাও একটি কুচক্রী মহলের সৃষ্টি। কতিপয় ব্যক্তি আমার সম্মানহানি ও তাদের বিরুদ্ধে চলমান অভ্যন্তরীণ তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করাসহ তাদের অপকর্ম ঢাকার জন্য বেনামি চিঠির মাধ্যমে মিথ্যা বানোয়াট ও অপপ্রচারমূলক তথ্য দিয়েছেন, যা কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী- বেনামি বা নামবিহীন বা ঠিকানাবিহীন দরখাস্তের ওপর কোনো প্রকার অনুসন্ধান চালানোয় বিধিনিষেধ রয়েছে। এরপরও গণমাধ্যমে এসব বেনামি চিঠির মাধ্যমে আইফোন-ল্যাপটপের বিনিময়ে প্রাইজ পোস্টিংয়ের তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে কবে ও কার কাছ থেকে এসব গ্রহণ করেছি তা উল্লেখ করা হয়নি। বাস্তবিকভাবে এসব মনগড়া তথ্য ছড়িয়ে আমার একটি কৃত্রিম চরিত্র উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি একটি অসাধু শ্রেণির সাজানো। মনগড়া তথ্য প্রকাশ করে অহেতুক মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করা ও আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এ ধরনের মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদপত্রের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করা হয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) সেলিনা বানু ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, বিগত ৩০ বছরে আমি সততা ও ন্যায়ের প্রশ্নে আপস করিনি। আমার পেশাগত কর্মদক্ষতা ও সততার কারণেই পদোন্নতি পেয়ে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছি। এ পদেও ৯ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি। আমার কারণে অতীতে অনেকেই নানা অনৈতিক সুবিধা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব কারণেই হয়তো একটি কুচক্রী মহল মনগড়া, বানোয়াট ও সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে আমার সম্মানহানির চেষ্টা করছে। তবে আমি এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নই।
তিনি আরো বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তে আমি সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। উপরন্তু, আমি চাই যারা আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করে আমার সম্মানহানি করেছেন, সঠিক তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসুক। আমার আয়-ব্যয়ের হিসাব সবসময় স্বচ্ছ থাকে। কারো কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আমি কোনো বাড়ি-গাড়ি বা অন্যান্য সম্পদ অর্জন করিনি। আমার ছেলে-মেয়েরা রিকশায় স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে। তদন্তে যদি কথিত সাড়ে ৭ কোটি টাকা ঘুষের জন্য দোষী সাব্যস্ত হই, তাহলে আমি আমার পদ থেকে পদত্যাগ করবো এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গৃহীত যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেবো।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের ভিসা শাখার একজন কর্মকর্তা ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, সেলিনা বানু ৯ বছর ধরে পাসপোর্ট অধিদফতরের এডিজি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এত বছরে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ওঠেনি। বরং তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর এখানকার অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন। কেউ ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন তথ্য ছড়াতে পারে।
এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মো. নুরুল আনোয়ারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মহাপরিচালকের স্টাফ অফিসার (সহকারী পরিচালক) মো. আজিজুল ইসলাম ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, এডিজি সেলিনা বানুর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে যে বা যারা দোষী তাদের খুঁজে বের করবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সেলিনা বানু ২০১৫ সালের ২২ জুলাই থেকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ডিআইপির প্রশাসন বিভাগের এডিজির পদটি শূন্য থাকায় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ঐ বিভাগের এডিজির দায়িত্বও পালন করছেন সেলিনা বানু।
সূত্র : ডেইলি বাংলাদেশ